সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৩ পূর্বাহ্ন

নির্যাতিত হচ্ছে ভিন্নমতাবলম্বীরা পাকিস্তানে অপহরণকারীদের হাতে

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৩ জুন, ২০২১

হাঁটতে হাঁটতে চুল কাটার সেলুনে যাচ্ছিলেন আইনজীবী ও সামাজিক মাধ্যম কর্মী শফিক আহমদ। চলতে চলতেই হঠাৎ তার মনে হয়- কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। তার ধারণা হলো- হয়তো তাকে অপহরণ করা হতে পারে।

ঠিক সেটাই ঘটে। কয়েক মুহুর্ত পরই একদল লোক এসে তাকে ধরে ফেলে এবং কাছেই রাখা একটি গাড়ির পেছনের সিটে তাকে জোর করে তুলে বসিয়ে দেয়।

ঘটনাটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের। পূর্বাঞ্চলীয় ওকারা শহরের রাস্তায় বসানো সিসিটিভিতে পুরো ঘটনা ধরা পড়েছে।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ৩৭ বছর বয়সী শফিক আহমদ প্রাণপণে ধস্তাধস্তি করছেন নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য, আর আক্রমণকারীরা আশপাশের পথচারীদের সতর্ক করছে, যেন তারা ব্যাপারটাতে নাক না গলায়।

আহমেদকে তুলে নিয়ে গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত তার কোনো খবরই কেউ জানতে পারেনি।

শফিক আহমদের বিশ্বাস, যে লোকেরা তাকে অপহরণ করেছিল, তারা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার লোক।

সরকারের সমালোচক

আহমেদ ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রশাসন এবং দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর একজন কড়া সমালোচক।

অনেকেই অভিযোগ করেন, পর্দার আড়াল থেকে সামরিক বাহিনীই পাকিস্তানের রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন করে।

শফিক আহমদের অন্তর্ধান এবং তার ওপর যে অত্যাচার করা হয়, তা অনেকের মতে ছিল এক বৃহত্তর ‘ক্র্যাকডাউনের’ অংশ – যার টার্গেট হলো ভিন্নমতাবলম্বীরা।

এর উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করছে এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ইমরান খানের পক্ষে নিয়ে আসার পেছনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, এমন অভিযোগ যারাই করছেন, তাদের কণ্ঠ রোধ করা। সামরিক বাহিনী এবং ইমরান খান উভয়েই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে থাকেন।

হাত-চোখ বেঁধে অত্যাচার

ওকারা শহরের সিসিটিভি ফুটেজের ফ্রেম থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর কি ঘটেছিল – সে ব্যাপারে তিনি বলেন, তারা আমাকে হাতকড়া পরিয়ে দিল, চোখ বেঁধে ফেললো।

তার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো অজ্ঞাত একটি জায়গায়। তিনি বলেন, তারা আমাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামালো এবং একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাকে ফেলে দিল। তার পর শুরু হলো নির্যাতন।

তিনি আরো বলেন, তারা আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তারা আমার কাপড়চোপড় খুলে উলঙ্গ করে ফেললো এবং চামড়ার বেল্ট আর লাঠি দিয়ে আমাকে মারতে লাগলো। অব্যাহতভাবে আমার পিঠে এবং পায়ের পাতায় পেটানো হলো।

একটা জানালাবিহীন ছোট ঘরের মধ্যে এই প্রহার চললো পাঁচ-ছয় দিন ধরে। আহমদের মনে হয়েছিল তিনি মারা যাবেন।

তিনি বলেন, ওরা আমাকে বলেছিল, তোমার মৃতদেহ আমরা নদীতে ফেলে দেবো।  আহমদ মুক্তির পাবার পর তার সারা গায়ের নির্যাতনের অসংখ্য ক্ষতচিহ্নের ভিডিও করে রেখেছেন।

আরো অনেকেই শিকার হয়েছেন এই ক্র্যাকডাউনের

শফিক আহমদের অপহৃত হবার পর থেকে এই অভিযান ক্রমান্বয়ে আরো ব্যাপক হয়েছে।

গত সপ্তাহে একজন সাংবাদিককে বন্দুকের মুখে বেঁধে পেটানো হয়। নির্যাতনকারীরা নিজেদেরকে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের লোক বলে পরিচয় দেয়।

এপ্রিল মাসে একজন ভাষ্যকার পার্কে হাঁটার সময় তাকে গুলি করে আহত করা হয়।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে আন্তর্জাতিক সূচক প্রকাশ করে – তাতে পাকিস্তানের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৫তম।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করেছেন এমন অভিযোগের ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে সরকার বা সেনাবাহিনী – করো দিক থেকেই কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

আইএসআই অবশ্য গত সপ্তাহের আক্রমণের ঘটনার সাথে তাদের কোনরকম সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছে।

আহমদ বলছেন, আটককারীরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রশ্ন করেছিল যে ফেসবুক ও টুইটারে তিনি যেসব পোস্ট দেন তার পেছনে আসলে কারা আছে?

“আমি তাদের বলেছিলাম, আমাকে এগুলো লিখতে অন্য কেউ বলে দেয়নি। দেশে বেসামরিক শাসনের গুরুত্ব সম্পর্কে আমার নিজের স্বাধীন বিশ্বাস আছে। কিন্তু তারা আমার এসব কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল না।”

তিনি বলেন, তাকে আরো জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কে তাকে টাকাপয়সা দিচ্ছে, এবং পাশতুন প্রটেকশন মুভমেন্ট ও অন্যান্য উদারনৈতিক অ্যাক্টিভিস্টদের সাথে তার কী ধরনের যোগাযোগ আছে।

উল্লেখ্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ এনে বড় বড় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে এই পাশতুন প্রটেকশন মুভমেন্ট।

আহমদের মনে হয়েছে যে তাকে জিজ্ঞাসাবাদকারীদের হাতে তার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলোর প্রিন্ট করা কপি ছিল।

“আমার চোখ বাঁধা থাকলেও আমি কাগজের শব্দ, পাতা উল্টানোর শব্দ পাচ্ছিলাম। তারা বলছিল, আপনি সামরিক মুখপাত্র সম্পর্কে এখানে কী লিখেছেন? আপনি সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এই এই কথা লিখেছেন। আপনি কেন তাদের সমালোচনা করছেন?”

আহমদ এর আগেও ২০১৯ সালের এপ্রিলে একইভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে “পাকিস্তানের বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অবমাননাকর পোস্ট আপলোড করার” আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়। তবে আদালতে তার বিরুদ্ধে আনা মামলাটির কার্যক্রম আটকে যায়।

এর পর জুন মাসে তাকে অপহরণ করে মারধর করা হয়। সতর্ক করে দেয়া হয় তিনি যেন সামাজিক মাধ্যমে তার কর্মকাণ্ড বন্ধ করেন।

এর পর ভোরবেলা তাকে তার বাড়ি থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে একটা রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়।

তাকে ছেড়ে দেবার আগে অপহরণকারীরা একটি ভিডিও করে। এতে শফিক আহমদকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখানো হয়। তাকে বলতে বাধ্য করা হয়: “আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় আর কখনো কাউকে নিয়ে সমালোচনা করবো না।‍”

তাকে হুমকি দেওয়া হয়, এ ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়া হবে, এবং যদি তিনি তার কর্মকাণ্ড আবার শুরু করেন তাহলে তাকে হত্যা করা হবে।

তিনি ঠিক তাই করেছিলেন। এর পর ডিসেম্বর মাসে তাকে আবার আটক করা হয়। তাকে আটক রাখা হয় দু’মাস।

ভিন্নমতকে স্তব্ধ করা

আরো অনেককেই এভাবে তাদের অনলাইনের কর্মকাণ্ডের জন্য আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলো কী সম্প্রচার করবে তার ওপর অনানুষ্ঠানিক সেন্সরশিপ আছে।

পাকিস্তানে বেশিরভাগ টিভি চ্যানেলেই যেসব ‘সরাসরি’ বা ‘লাইভ’ রাজনৈতিক টক শো হয় সেগুলো আসলে সম্প্রচার হয় একটু দেরিতে। যাতে প্রযোজকরা কোনো আলোচক খুব বেশি সমালোচনা করলে তার কথা মিউট বা নিঃশব্দ করে দিতে পারেন।

গত বছর একজন ভাষ্যকার দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার অভাবের সমালোচনা করলে তাকেও এভাবে মিউট করে দেওয়া হয়েছিল।

এসব বিধিনিষেধ এড়ানোর জন্য সাংবাদিক আসাদ আলি তুর ইউটিউবে ভিডিও পোস্ট করা শুরু করেন।

এর পর তুরকে একটি আইন নোটিশ পাঠানো হয়। তাতে বলা হয় যে তিনি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর ভাষা ব্যবহার করেছেন।

নভেম্বর মাসে আদালত এই মামলা খারিজ করে দেয়। কিন্তু গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদে তুরের ফ্ল্যাটে একদল লোক জোর করে ঢুকে পড়ে। তুর বলেন, তাকে বেঁধে ফেলা হয় এবং একজন লোক তার পিস্তল দিয়ে তার কনুইয়ে জোরে জোরে আঘাত করতে থাকে।

তুর বলেন, তাকে আইএসআই জিন্দাবাদ, পাকিস্তান সেনাবাহিনী জিন্দাবাদ বলে স্লোগান দিতে বাধ্য করা হয়।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তুর তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কোনো মতে বের হয়ে এসে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছেন।

এইচ বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর এ আপনাকে স্বাগতম। “সময়ের প্রয়োজনে- HBD NEWS24” নিয়ে আমরা আছি আপনার পাশে। আপনার পাশে ঘটে যাওয়া নানা সংগতি, অসংগতি আর তথ্য নিয়ে আপনিও যোগ দিন HBD NEWS 24 এ আমাদের কাছে মেইল করুন: hbdnews24@yahoo.com

More News Of This Category

© All rights reserved © 2012 HBDNEWS24

POWERED BY MH GROUP OF COMPANY.