জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, আত্মতুষ্টিতে ভোগা যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ বাড়তে সময় লাগবে না। দেশে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট এবং ইউকে ভ্যারিয়েন্টের আধিপত্য রয়েছে। সেই সঙ্গে অনেকের আশঙ্কা, ইতোমধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টও চলে এসেছে।
গত ২৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতর তাদের সাপ্তাহিক বিশ্লেষণে জানায়, ওই সপ্তাহে তার আগের সপ্তাহের চেয়ে নমুনা পরীক্ষা এবং শনাক্তের সংখ্যা কমেছে, তবে বেড়েছে মৃত্যু এবং সুস্থতার সংখ্যা।
অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত সপ্তাহে (১১-১৭ এপ্রিল) পর্যন্ত দেশে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৭৪টি। পরের সপ্তাহে (১৮-২৪ এপ্রিল) হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৯১৬টি। নমুনা পরীক্ষার হার কমেছে দুই দশমিক ৪০ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার সংক্রমণ এমনিতেই দ্রুত ছড়াচ্ছে। গতবারে পরিবারে একজন সদস্য আক্রান্ত হলেও বাকিরা কম আক্রান্ত হয়েছিলেন। এবার এক পরিবারের সবাই একসঙ্গে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর জটিলতাও আগেরবারের চেয়ে বেশি। যার কারণে দেশে এবার একদিনে সর্বোচ্চ ১১২ জনের মৃত্যু আমরা দেখেছি। মৃত্যুও হচ্ছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে।
গত মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। সংক্রমণ এবং মৃত্যু ঠেকাতে গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা দেওয়া হয়। যা চলবে আগামী ৫ মে পর্যন্ত। সময়সীমা ৫ মে’র পরে আরও বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। তবে কৌশল পরিবর্তন হতে পারে বলে সূত্রে জানা গেছে।
এ সময় সংক্রমণের সঙ্গে কমতে শুরু করেছে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপও। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২৯ এপ্রিলের বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে ১২ হাজার ৩৬৫টি সাধারণ বেডের মধ্যে খালি রয়েছে ৮ হাজার ৩৩৫টি। অর্থাৎ প্রায় ৬৭ শতাংশ সাধারণ বেড খালি। এছাড়া সারাদেশে আইসিইউ বেড আছে এক হাজার ৮৪টি। খালি আছে ৪৫৯টি।
ঢাকার হাসপাতালগুলোতে সাধারণ বেড আছে ৫ হাজার ৬৪৪টি, খালি আছে ৩ হাজার ৪১৩টি।
এদিকে, লকডাউন করোনা নিয়ন্ত্রণের নিরাপদ কৌশল মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, লকডাউনের মাধ্যমে সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব হয়।
তিনি বলেন, লকডাউনের মাধ্যমে জনসাধারণের চলাচল সীমিত করার লক্ষ্যই হচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ব্রেকিং পয়েন্টের বাইরে যেতে না দেওয়া।
শনাক্তের হার কমার কারণ জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একদিনের শনাক্তের হার দিয়ে কিছু বোঝা যাবে না। এটা যদি আরও দুই সপ্তাহ থাকে, তবে বলতে হবে বিধিনিষেধ কাজে এসেছে।
‘আমাদের কিছুতেই ৫ এপ্রিলের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া যাবে না’ এমন মন্তব্য করে ডা. মুশতাক বলেন, ‘শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে না আসা পর্যন্ত আংশিক হলেও বিধিনিষেধ, বিশেষ করে জনসমাগম, পর্যটন কেন্দ্র, কমিউনিটি সেন্টার বন্ধ রাখতে হবে। শপিং মল আংশিক খোলা ও গণপরিবহন অর্ধেক খালি রেখে চালাতে হবে।
গত বছর ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে যখন লকডাউন ছিল না, তখন সংক্রমণ কেন কমেছিল, এমন প্রশ্নে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তখন শীত ছিল। কিন্তু এখন কেন কমেছে সেটা বুঝতে পারছি না। যেহেতু লকডাউন দেওয়া হয়েছে সেটারও ফল হতে পারে। এর জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।’
‘সংক্রমণের হার ১০-এর নিচে নেমেছে। কিন্তু গতকাল মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৭৭। আজ (২৯ এপ্রিল) আবার ৮৩। এটা দিয়ে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না’- এমনটা বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল।
তিনি বলেন, ‘মৃত্যু যে অঞ্চলে হচ্ছে, সেখানকার চারপাশে কত মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন, সেটা খুঁজে বের করা জরুরি। তাতে সংক্রমণের বিন্যাসটা ভালোভাবে বোঝা যেতো।’
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় (২৮-২৯ এপ্রিল) করোনায় নতুন শনাক্ত হয়েছেন দুই হাজার ৩৪১ জন। যা গত ৩৯ দিনের মধ্যে সর্বনিম্ন।
নতুন শনাক্ত হওয়া দুই হাজার ৩৪১ জনকে নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত শনাক্ত সাত লাখ ৫৬ হাজার ৯৫৫। একই সময়ে আক্রান্ত ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় অধিদফতর। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত মারা গেলেন ১১ হাজার ৩৯৩ জন।
ওই সময়ে রোগী শনাক্তের হার ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ।