করোনার অতি সংক্রমণশীল ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ফের তাণ্ডব চালাচ্ছে। গত দুই বছর ধরে চলা মহামারিতে বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের ত্রাসকে এতদিন ‘ঢেউ’ বলা হলেও ওমিক্রন তাণ্ডবকে বলা হচ্ছে ‘সুনামি’। সারাবিশ্বেই আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলছে করোনার নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট, বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, দেশে গত জুন-জুলাই ও আগস্টে ডেল্টা-তাণ্ডব চললেও এবারের ওমিক্রন সেটাকে ছাড়াবে। মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে রোগী বাড়তে থাকলে মৃত্যুও বাড়বে।
ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে রোগী বাড়তে দেখা গেছে। এ কথা স্বীকার করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরও। অধিদফতর বলছে, এভাবে রোগী বাড়তে থাকলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রভাব পড়তে সময় লাগবে না। রোগী বাড়ার কারণে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে আবারও কোভিড ডেডিকেটেড করা হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল জানিয়েছে, সেখানেও বাড়ছে রোগীর চাপ।
এমন পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যে ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত রোগীর হিসাব দেওয়া হয়, সেটা প্রকাণ্ড হিমবাহের চূড়ামাত্র। প্রকৃত রোগী তারচেয়ে কয়েক গুণ বেশি। শনাক্ত না হওয়ার বড় কারণ নমুনা পরীক্ষার সংকট।
বেসরকারি পর্যায়ে তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা ফি আর সরকারি পর্যায়ে নানা হয়রানি ও বিলম্বের কারণে মানুষ পরীক্ষা করাচ্ছে কম।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন অধিদফতরের ভার্চুয়াল বুলেটিনে বলেছেন, বর্তমানে রোগী শনাক্তের ঊর্ধ্বগতির হার শুধু যে বাড়ছে তা নয়, এটা ‘প্রোগ্রেসিভলি’ বাড়ছে। এটা অ্যালার্মিং।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকেই টেস্ট করছেন না। উপসর্গযুক্ত রোগীদের সবাইকে টেস্ট করালেও সংখ্যাটা আরও বাড়তো।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, ২৪ ঘণ্টায় (২৩ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে ২৪ জানুয়ারি সকাল ৮টা) করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৮২৮ জন। এর আগে ডেল্টার সময় দিনে এ পরিমাণ শনাক্ত হতো। প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পর শনাক্ত হয়েছে ১৫ হাজারের কাছাকাছি। এর আগে গত ৩ আগস্ট ১৫ হাজার ৭৭৬ জন শনাক্ত হয়েছিলেন।
ওই ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। যা গত ছয় মাসে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ২৪ জুলাই শনাক্তের হার ছিল ৩২.৫৫ শতাংশ। ওটাই ছিল মহামারিকালে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে করোনায় নতুন শনাক্ত রোগী বেড়েছে ১৮০ শতাংশ এবং মৃত্যু বেড়েছে ৮৮ শতাংশ।
সোমবার অধিদফতর জানায়, গত সপ্তাহে (১৭-২৩ জানুয়ারি) করোনায় নতুন শনাক্ত হয়েছেন ৬৭ হাজার ৪২৫ জন। এর আগের সপ্তাহে হয়েছেন ২৪ হাজার ১১ জন। অর্থাৎ আগের সপ্তাহের তুলনায় গত সপ্তাহে রোগী বেড়েছে ১৮০ দশমিক ৮ শতাংশ।
এই সংখ্যাও প্রকৃত চিত্র নয়। টেস্ট যত বাড়বে, রোগীও তত বাড়বে। শনাক্ত রোগী কম হলে সেটা কখনোই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে না বলে মন্তব্য করেছেন কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান।
তিনি বলেন, সংক্রমণ আকাশচুম্বী। আর যেহেতু ব্যাপকভাবে দেশে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না, সেজন্য সংক্রমণের হার এবং শনাক্তের প্রকৃত চিত্র আমরা পাচ্ছি না।
সরকারি পর্যায়ে নানা ভোগান্তি, বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চ ফির কারণে মানুষ টেস্ট বিমুখ হচ্ছে। অথচ ঘরে ঘরে রোগী, যারা টেস্ট করাচ্ছে না। এ অবস্থা পরিবারে, বন্ধুমহলে। এসব রোগীরা হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক আর্সলান বলেন, ‘আমরা যদি না জানি প্রকৃত রোগী কত, তবে কোন পদক্ষেপ নিতে হবে, কী করে এলাকা ধরে এগোতে হবে সেটাও বুঝতে পারবো না।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন যে রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন পাচ্ছি, সেটা হচ্ছে টিপ অব দ্য আইসবার্গ। চারপাশে তাকালেই বোঝা যায়, আনরিপোর্টেড কেস কত।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু ওমিক্রনের লক্ষণ মারাত্মক নয়, হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে না অনেককে, তাই ৯০ ভাগ মানুষই পরীক্ষার বাইরে থাকছে।’
যে ১০ ভাগ মানুষ পরীক্ষা করছে, তাদের ভেতর থেকেই হাজার হাজার মানুষ শনাক্ত হচ্ছে। এতে বাকি চিত্রটা সহজেই অনুমান করা যায় বলে জানান ডা. বে-নজির।
এ হিসাবে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা হাজার নয়, লাখের ঘরে থাকবে বলেই ধারণা তার।