অস্ত্রের জোরে ক্ষমতার মসনদে বসা সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের জনসমর্থন আদায় করতে পারেনি। গত আড়াই মাসে দেশটির সর্বস্তরের মানুষ উল্টো তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে রাজপথে। আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থনও আদায় করতে পারেনি জান্তা সরকার। উল্টো একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জুটেছে কপালে।
সব মিলিয়ে বড় ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপের মধ্যে আছে জান্তা সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে খুব বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা জান্তা সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিশেষ করে ‘একা একা’ অর্থনৈতিক ধস সামাল দেওয়া তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে গৃহযুদ্ধের চক্করেও পড়ে যেতে পারে এশিয়ার এই দেশটি। বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে জানিয়েছে যে চলতি অর্থবছরে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘ফিচ সলিউশনস’ বলছে, ১০ শতাংশ নয়, মিয়ানমারের প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। বিশ্বব্যাংকের এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ অদিত্য মাথু বলেন, ‘মিয়ানমারের মতো গরিব রাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ কমে যাওয়া অবশ্যই তাদের জন্য অশনিসংকেত।’
গত ১ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। গ্রেপ্তার করা হয় স্টেট কাউন্সেলর সু চি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ এনএলডির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। জারি করা হয় এক বছরের জরুরি অবস্থা। সেনাবাহিনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এক বছর পর নতুন নির্বাচন দেওয়া হবে। তবে সাধারণ মানুষ এই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করছে না।
জনবিচ্ছিন্ন জান্তা সরকার
মিয়ানমারের মানুষ টানা পাঁচ দশকের বেশি সময় সামরিক শাসনের জাঁতাকলে ছিল। ফলে তারা আর সামরিক শাসন চায় না। এ ছাড়া সেখানকার জনগণ গত পাঁচ বছরে গণতন্ত্রের ন্যূনতম স্বাদ হলেও পেয়েছে। ফলে গণতান্ত্রিক ও সামরিক সরকারের পার্থক্য তাদের কাছে কিছুটা হলেও স্পষ্ট। এ অবস্থায় অভ্যুত্থানের পরেই নিজ নিজ জায়গা থেকে জান্তার বিরুদ্ধে সরব হয় দেশটির সাধারণ মানুষ। জান্তাকে বেকায়দায় ফেলতে ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের ডাক দেয় তারা। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে লাখ লাখ সরকারি চাকরিজীবী কর্মবিরতি শুরু করেন। ফলে দেশটির সেবামূলক সব খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে আছেন চিকিৎসক, ব্যাংককর্মী, প্রকৌশলী, শুল্ক কর্মকর্তা ও রেলের কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার কয়েক লাখ মানুষ। আন্দোলনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা বলছেন, তাঁরা কাজে যোগ না দিলে জান্তা সরকার একসময় কোণঠাসা হয়ে পড়বে।
অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে মিয়ানমারের অন্তত দুই ডজন আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে। এদের মধ্যে কয়েকটি সংগঠন গত ৩০ মার্চ জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার হুমকি দেয়। এরই মধ্যে এসব সংগঠনের হামলায় ১৪ পুলিশ ও ১২ সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব সংগঠন আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলে মিয়ানমারে অবধারিতভাবে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে।
মারমুখী জান্তা
রাজপথে আন্দোলন চললেও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের আলোচনায় বসার আগ্রহ দেখায়নি জান্তা সরকার। বরং বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে তারা। স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স’-এর (এএপিপি) হিসাব অনুযায়ী, গত আড়াই মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সাত শতাধিক বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। গ্রেপ্তার কিংবা গুম করা হয়েছে অন্তত তিন হাজার ব্যক্তিকে। বিক্ষোভ দমাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট সংযোগও। অনেক জায়গায় জারি করা হয়েছে সামরিক আইন।
বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ
বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধে এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে জান্তা সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে নিউজিল্যান্ড। জান্তা সরকারের নিন্দা জানিয়েছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ‘জি-সেভেন’। দেশটির সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে ওয়াশিংটন। জান্তা সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও কানাডাও। জাতিসংঘ শুরু থেকেই জান্তার সমালোচনা করে আসছে। প্রতিবাদে শামিল হয়েছে ফেসবুকও। তারা জান্তা সরকারের সব অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে।