সরকারিভাবে ১১ লাখ টন চাল আমদানির কার্যক্রম শুরু হলেও এক লাখ ৯৪ হাজার টন এসেছে।
অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ে সাড়ে ১৩ লাখ টনের বেশি আমদানির অনুমতি দিলেও এ পর্যন্ত তিন লাখ ৮০ হাজার টন এসেছে। অর্থাৎ, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ২৫ লাখ টন চাল আমদানির টার্গেট থাকলেও দেশে চাল প্রবেশ করেছে পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার টন। ফলে আমদানি করা চাল দিয়ে স্থানীয় বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, দেশে বোরো ও আমনের ফলন কম হওয়ায় আগস্টে প্রয়োজনীয় চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর সেই সুযোগ গ্রহণ করেনি। সময়মতো চাল আমদানি না-করায় আজকের এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে সাবেক খাদ্যসচিব ও বিশিষ্ট কলামিস্ট আব্দুল লতিফ মণ্ডল সোমবার যুগান্তরকে বলেন, গত বোরো ও আমন মৌসুমে চালের ফলন কম হয়েছে তা সরকারের সবাই কমবেশি জানত।
এ কারণে গত বছরের আগস্টে প্রয়োজনীয় চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের নানা গড়িমসির কারণে কাঙ্ক্ষিত চাল আমদানি করা সম্ভব হয়নি। আমদানির জন্য প্রধানমন্ত্রী তাদের ব্ল্যাংক চেক দিলেও তারা কাজে লাগায়নি। এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযানও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
এতে সরকারি মজুত কমার পাশাপাশি বাড়তে থাকে চালের দাম। ফলে চাল আমদানিতে মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে ২০১৭ সালের মতো আমদানি শুল্ক তুলে দিয়ে দ্রুত সরকারি সংগ্রহ ও মজুত বাড়াতে হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ২১ মার্চের তথ্যানুযায়ী, সরকারি গুদামে বর্তমানে মজুত রয়েছে পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার ৭১ টন খাদ্যশস্য। এরমধ্যে চার লাখ ৭৭ হাজার ২৭ টন চাল এবং ৭৯ হাজার ৪৪ টন গম। গত বছর একই সময়ে মজুত ছিল ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৪৬ টন খাদ্যশস্য। এরমধ্যে ১৪ লাখ ১৪ হাজার ৩৫ টন চাল এবং তিন লাখ ১৭ হাজার ১১ টন গম। অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় প্রায় ১২ লাখ টন মজুত কম।
জানা গেছে, সিদ্ধ চাল ও আতপ চাল আমদানির গতি বাড়াতে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরও ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। যাতে করে কম খরচে দ্রুত চাল আমদানি করে স্থানীয় বাজারের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
এর আগে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়ার সময় আমদানি শুল্ক ৬২.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে সরকারি গুদামের মজুত পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক হয়।
এতে খাদ্যসচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন সদস্য মন্ত্রীর দপ্তরে বৈঠক করেন। সেখানে খাদ্যমন্ত্রী চাল আমদানির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়, বেসরকারিভাবে ৩২০ জন আমদানিকারককে ১০ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।
কিন্তু এলসি খোলার সময়সীমা দুবার বাড়ানোর পরও ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনেকে এলসি খোলেননি। অনেকে এলসি খুললেও চাল আমদানি করেনি। এলসি খোলা ও আমদানির পরিমাণ হতাশাজনক। এ কারণে নির্ধারিত সময়ে যারা এলসি খোলেননি, তাদের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। খাদ্যসচিব বলেন, বেসরকারিভাবে আমদানি করা চালের পরিমাণ আশানুরূপ না-হওয়ায় বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
আমদানির সিদ্ধান্তের শুরুতে কিছুটা দাম কমলেও পুনরায় ধান ও চালের দাম বাড়ছে। ভারত থেকে ধীরগতিতে চাল আসায় পর্যাপ্ত মজুত গড়ে তোলা যাচ্ছে না। বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ওএমএসও বিতরণ করা যাচ্ছে না। শুধু মহানগরী ও জেলা শহরগুলোয় সীমিত পরিমাণে ওএমএস কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত বেসরকারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল আনার বিপরীতে এলসি খোলা হয়েছে আট লাখ ২৬ হাজার টন, যা মোট বরাদ্দের অর্ধেকের কিছু বেশি। আর চাল দেশে এসেছে তিন লাখ ৮০ হাজার টন। আর সরকারিভাবে টেন্ডার এবং জিটুজি পদ্ধতিতে ১১ লাখ টনের বেশি চাল আনার প্রক্রিয়া চলছে।
এরমধ্যে দেশে চাল এসেছে এক লাখ ৯৪ হাজার টন। ভারতসহ আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চারটি টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। অনেকে চাল দিতে পারছে না। যেখানে বিশ্ববাজারে চালের দাম টনপ্রতি ৪২০-৪৩০ ডলার, সেখানে টেন্ডারে দর নির্ধারণ হয়েছে ৩৯৭ ডলার। ফলে প্রতি টনে লোকসান দিতে হবে ৩০-৩৫ ডলার পর্যন্ত। এ কারণে চারটি টেন্ডার বাতিল করতে হয়েছে।
পাশাপাশি ভারত থেকে চাল আমদানি করতে সীমান্তের ওপারে নানা হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ফলে চাল আমদানিতে গতি পাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে খাদ্যসচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা চাল আমদানির চেষ্টা করছি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং চাল পরিবহণে জাহাজ না-পাওয়ায় দেরি হচ্ছে। আমদানির মাধ্যমে মজুত বাড়ানো হবে।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দেওয়া সত্ত্বেও কেন সময়মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি-এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ওই সময় আমন ধান মাঠে ছিল, আউশ সংগ্রহের বিষয় ছিল। সে সময় আমদানির উদ্যোগ নিলে কৃষক ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ধান-চালের উৎপাদন নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় যে তথ্য দেয় তাতে ফাঁক রয়েছে। ৯ আগস্ট বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) আয়োজিত খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক সেমিনারে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক (ডিজি) শাহজাহান কবীর জানান, ‘চাহিদা মেটানোর পরও আগামী নভেম্বরের শেষে বাংলাদেশে সাড়ে ৫৬ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে।’