ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ককে ঘিরে কৌতূহল রয়েছে বিশ্বজুড়েই। তাদের মধ্যকার বিদ্যমান সম্পর্কের টানাপোড়েন আর তা উন্নয়নের সম্ভাব্যতা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি।
পাক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার রশীদ বাজওয়া যখন বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে নিরাপত্তা সম্পর্কিত এক অনুষ্ঠানে অতীতের বিরোধকে কবর দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের কথা বললেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাশ্মীর সংকট সমাধানের কথা বললেন-স্বভাবতই তা অনেকের নজর কেড়েছে।
কারণ, পাকিস্তানে ক্ষমতার কলকাঠি যে সেনাবাহিনীর হাতে তা নিয়ে বিশেষ কোনো বিতর্ক নেই।
জেনারেল বাজওয়াই শুধু নয়, তার আগের দিন ওই একই অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও ভারতের সঙ্গে তার দেশের শান্তি স্থাপনের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, আঞ্চলিক শান্তি থাকলেই ভারত মধ্য এশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ পাবে।
প্রধানমন্ত্রী খান এবং সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়ার কথা অনেকটাই প্রতিধ্বনিত করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশীও।
ইসলামাবাদের ওই নিরাপত্তা সম্মেলনে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর তার ভাষণে পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের সরকার ভারতের সঙ্গে বিরোধের বদলে সহাবস্থান এবং সহযোগিতার সম্পর্কে ইচ্ছুক।
তবে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে জেনারেল বাজওয়ার বক্তব্য। তার ভাষণে ভারত নিয়ে অনেক কথাই ছিল।
দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়ার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে এই দুই অঞ্চলের সমৃদ্ধির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে বিরোধের কারণে সেই সম্ভাবনা জিম্মি হয়ে পড়েছে।
জেনারেল বাজওয়া স্বীকার করেন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে বৈরিতার মূলে রয়েছে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ। তিনি বলেন, ‘কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না হলে উপমহাদেশের শান্তি এবং বোঝাপড়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বাগ্বিতণ্ডার ঝুঁকিতেই থেকে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে পাকিস্তানের এই নীতিগত সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো চাপ নেই, বরং রয়েছে বাস্তব যুক্তি।
পাকিস্তানের মহা-ক্ষমতাধর সেনাপ্রধানের এই ভাষণ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে শুরু হয়েছে নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।
তার এই বক্তব্যের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কী, তাকে কতটা ভরসা করা যায়, ভারতের বর্তমান সরকার এতে কতটা সাড়া দেবে, তাদের মনোভাব কী হতে পারে-সবই জল্পনা-কল্পনার অংশ।
লন্ডনে সোয়াস ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসির গবেষক এবং পাকিস্তান রাজনীতির বিশ্লেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তান সেনাপ্রধান এবং ক্ষমতাসীন সরকারের এসব ইঙ্গিতের টার্গেট ভারত যতটা, তার চেয়ে বেশি আমেরিকা। আর এই বার্তার পেছনে সবচেয়ে প্রধান যে তাড়না- তা হলো পাকিস্তানের অর্থনৈতিক তাড়না।
ড. সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তান বুঝতে পারছে, আমেরিকার প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের নীতিতে তারা অনুপস্থিত। ভারত সেখানে মধ্যমণি। সেটা অবশ্যই পাকিস্তানের বড় মাথাব্যথা। সেজন্য খেয়াল করবেন, জেনারেল বাজওয়া বলেছেন চীনের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) অর্থ এই নয় যে পাকিস্তান শুধু সেটির ওপরই ভরসা করছে।
ড. সিদ্দিকা বলেন, চীন পাকিস্তানের বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে ৪৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে ঠিকই, কিন্তু তার সবটাই দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, নগদ কোনো অর্থ নয়। ঋণের এই টাকা শোধ দেওয়া নিয়েও এক ধরনের উদ্বেগ রয়েছে।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের নগদ অর্থের সংকট বেড়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব তাদের ঋণের টাকা ফেরত চাইছে। আমেরিকার কাছ থেকে যে নগদ অর্থ আসত তাতেও ঘাটতি পড়েছে।
এই গবেষক আরও বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে এখনো অত্যন্ত প্রয়োজন পাকিস্তানের। আইএমএফের টাকা নিতেও আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্টতা দরকার। পশ্চিমা বিনিয়োগের জন্য এখনো আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্ব অনেক।
চীন সম্প্রতি পাকিস্তানের তৈরি পোশাকের জন্য বাজার খুলে দিয়েছে, কিন্তু এখনো পাকিস্তানের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, সম্পর্ক ভালো হলে ভারতের বিশাল বাজারও পাকিস্তানের জন্য বিরাট সুযোগ তৈরি করবে।
কিন্তু বড় প্রশ্ন হচ্ছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে কতটা ইচ্ছুক?
ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলছেন, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে জেনারেল বাজওয়া কী তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার কথা বলছেন, নাকি পাকিস্তানের সেনা নেতৃত্বের বৃহত্তর অংশের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছেন।
মোদি সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে ভারতশাসিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজের পর সেই বৈরিতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। তাহলে জেনারেল বাজওয়া কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের যে কথা বলছেন, তা কীভাবে হতে পারে?
ড. আয়েশা মনে করেন, জেনারেল বাজওয়ার হাতে কাশ্মীর নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ফর্মুলার পুনরুত্থান করা ছাড়া তেমন কোনো বিকল্প নেই।