পাইকারি বাজারে চালের দাম কেজিতে ১ থেকে ২ টাকা কমেছে। ফলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দাম বাড়ার যে প্রবণতা চলছিল, তাতে আপাতত লাগাম পড়েছে। ধানের বাজার পড়ে যাওয়ায় চালের বাজারেও দাম কমেছে বলে দাবি মিল মালিকদের। কয়েক দিনের মধ্যে দাম আরও কিছুটা কমতে পারে বলে তারা জানিয়েছেন।
এর আগে গত তিন সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে ছয় থেকে আট টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। ধানের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের কারণে দাম বাড়িয়ে দেন মিল মালিকেরা। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গত মঙ্গলবার থেকে সারা দেশের মতো নওগাঁর চালকল ও ধানের আড়তের গুদামে ধান-চালের অবৈধ মজুতবিরোধী অভিযানে নামে জেলা প্রশাসনের একাধিক দল। প্রশাসনের অবৈধ মজুতবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে নওগাঁর হাট-বাজারে কমতে শুরু করে ধানের দাম। গত চার দিনে প্রকারভেদে ধানের দাম প্রতি মণে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
ধানের দাম কমায় চালের পাইকারি বাজারে চালের দাম কমে যায়। তবে স্থানীয় খুচরা বাজারে এখনো চাল আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে খুচরা বাজারেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন মিল মালিক ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার ধান-চালের অবৈধ মজুতবিরোধী অভিযান শুরু করার কারণে যেসব চালকল কিংবা আড়তে মজুত শর্তের অতিরিক্ত ধান কেনা ছিল তারা জরিমানার ভয়ে ধান কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার অনেক মুজতদার যারা হাটবাজারে ধান কিনে মজুত করেন, কিন্তু লাইসেন্স নেই। এ ধরনের ব্যবসায়ীরা ধান কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। এর ফলে ধানের বাজার গত তিন দিনে প্রতি মণে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। এছাড়া অবৈধ মজুতবিরোধী অভিযানের ভয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় বাজারের চালের আড়তদাররা মোকাম থেকে চাল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। এজন্যই চালের দাম কমে গেছে।
জেলার অন্যতম বড় ধানের বাজার ছায়তনতলী হাট। এই হাট সপ্তাহের প্রতিদিন ধান কেনা-বেচা হয়ে থাকে। শনিবার সকালে ওই বাজারের একাধিক ধান আড়তদার ও ধান বিক্রি করতে আসা কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারটিতে প্রতিমণ জিরা ধান মানভেদে ১২৩০ থেকে ১২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সোমবার এই বাজারে জিরা ধানের দাম ছিল ১৩৫০ থেকে ১৩৮০ টাকা পর্যন্ত। আর কাটারিভোগ ধানের দাম গত সোমবার বিক্রি হয়েছে ১৪৫০ টাকায়। সেই ধান এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩০০ থেকে ১৩৫০ টাকায়।
হঠাৎ ধানের দাম কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। ছায়তনতলী বাজারে শনিবার সকালে ধান বিক্রি করতে এসেছিলেন মহাদেবপুর উপজেলার তিলন গ্রামের রুস্তম আলী। কত টাকায় ধান বিক্রি করলেন, তা জানতে চাইলে মলিন মুখে তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগেও জিরা ধানের দাম ১৩৮০ টাকা ছিল। সংসার প্রয়োজনে আজ ১০ মণ ধান হাটে আনছিলাম। কিন্তু বাজারে আড়তদাররা সেই ধান দেখে কোনো আড়তদারই ১২৫০ টাকার বেশি কইল না। শেষম্যাষ বাধ্য হয়ে ওই দামেই ধান বিক্রি করে দিয়েছি। প্রতি মণ ধানে প্রায় ১৫০ টাকাই নাই। এমন আচমকা ধানের দাম কমে য্যাবে- ধারণাই করিনি।’
ছায়াতলী বাজারের ধানের আড়তদার মতিউর রহমান বলেন, ‘প্রশাসনের মজুতবিরোধী অভিযান শুরুর মহাজনেরা (মিল মালিক) ধান কমে দিয়েছে। আগে যেখানে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ গাড়ি ধান কিনতেন, এখন সেখানে এক থেকে দুই গাড়ি ধান কিনছেন। আমার দুইজন মহাজনের জন্য আগে সপ্তাহে প্রায় ৩ হাজার মণ ধান কিনতাম। এখন সেখানে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার মণ ধান কিনতেছি। অভিযানের ভয়ে বেশি ধান কিনতে পারছি না। গুদামে বেশি ধান পেলে যেকোনো সময় ম্যাজিস্ট্রেট এসে জরিমানা করতে পারেন।’
দেশের অন্যতম বৃহৎ চালকল বেলকন গ্রুপের চালকল। এই গ্রুপের একাধিক মিল থেকে উৎপাদিত মিনিকেট চাল সারা দেশে রজনীগন্ধা ব্র্যান্ড হিসেবে বিক্রি হয়ে থাকে।
বেলকন গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক আবু ওয়াহিদ হোসেন বলেন, ‘ধানের দাম কমে যাওয়ায় চালের দাম প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। কয়েক দিন আগে আমাদের প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৩৩০০ টাকায়। সেই চাল এখন ৩১৫০ থেকে ৩২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’
নওগাঁ জেলা চাউল কল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ চকদার বলেন, ‘ঝড়-বৃষ্টির কারণে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ও করপোরেট ব্যবসায়ীদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে বোরো মৌসুমের ধান বাজারে আসার পর থেকেই ধান-চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল। বাজার নিয়ন্ত্রণে গত মঙ্গলবার থেকে সরকারের অভিযান শুরুর পর যেসব মিলার মজুত নীতি অনুযায়ী অতিরিক্ত ধান গুদামজাত করেছিল, তাদের কেউ ধান কেনা বন্ধ করে দিয়েছে, আবার কেউ কম পরিমাণে ধান কিনছে। এর ফলে বাজারে ধানের দাম প্রতি মণে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা করে কমে গেছে। হাটেবাজারে ধানের দাম কমতে শুরু করায়, পাইকারি বাজারে গত বুধবার থেকে চালের দাম প্রতি কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা কমেছে।