শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় বিসিক শিল্পনগরীর মাছু অ্যান্ড সন্স ইন্ডাস্ট্রিতে দুই নৈশপ্রহরী হত্যারহস্য উন্মোচিত হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত তিনজনকে গ্রেফতারের পর হত্যার কারণ জানা যায়।
গ্রেফতার তিনজন জানান- কারখানার ঢালাইসামগ্রী অতিরিক্ত নিতে বাধা ও তা মালিকের কাছে প্রকাশ করতে চাওয়ায় ট্রাকের চালক, হেলপার ও সাবেক কর্মচারী পরিকল্পিতভাবে ওই দুইজনকে হত্যা করে। তাদের মাথায় আঘাতে হত্যার পর লাশ সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেন। ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তারা এক ভিকটিমের মোবাইল ফোন দিয়ে খুদেবার্তা পাঠিয়ে অপহরণ নাটক করেন।
গ্রেফতারের পর তারা পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তাদের কাছে হত্যায় ব্যবহৃত একটি রড, নিহতের মোবাইল ফোন এবং আসামির একটি মোবাইল ফোন পাওয়া গেছে।
রোববার বিকালে তিনজনকে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ শাহরিয়ার তারিকের আদালতে হাজির করলে দুজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। অপরজনকে দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী রোববার দুপুরে তার কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য দেন।
গ্রেফতার তিন আসামি হলেন- মাছু অ্যান্ড সন্স ইন্ডাস্ট্রির ট্রাকচালক বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার চকলোকমান এলাকার মৃত মিসবাহুল মিল্লাত নান্নার ছেলে হোসাইন বিন মিল্লাত ওরফে নিনজা (৩৪), হেলপার বগুড়া শহরের নারুলী তালপট্টির বদিউজ্জামান প্রামাণিকের ছেলে রাহাত প্রামাণিক (২১) ও সাবেক কর্মচারী একই এলাকার সায়েদ হামান বেপারীর ছেলে সুমন বেপারী (২৭)।
পুলিশ সুপার জানান, ট্রাক চালক নিনজা ও হেলপার রাহাত কারখানা থেকে সবসময় অতিরিক্ত মালামাল নিয়ে যেতেন। এতে মালিকের ক্ষতি হচ্ছে ভেবে বিশ্বস্ত নৈশপ্রহরী আবদুল হান্নান (৪৫) ও সামসুল হক (৬৬) বাধা দিয়ে আসছিলেন। বিষয়টি তারা মালিকের কাছে প্রকাশ করার কথা বলেন। ধরা পড়ার আশঙ্কায় নিনজা ও রাহাত দুই নৈশপ্রহরীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
তিনি বলেন, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে শহরের খোকন পার্কে নিনজা, রাহাত ও সুমন আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় সুমন তাদের কাছে ১০ হাজার টাকা ধার চান। কিন্তু একটা কাজ করলে নিনজা তাকে দুই লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কি কাজ করতে হবে জানতে চাইলে নিনজা তাকে (সুমন) ২৪ ফেব্রুয়ারি ফজরের নামাজের পর মাছু অ্যান্ড সন্স ইন্ডাস্ট্রিতে যেতে বলেন। তখন সুমন বলেন, তিনি সাবেক কর্মচারী; নৈশপ্রহরীরা তাকে কারখানায় ঢুকতে দিবেন না।
এ সময় নিনজা তাকে জানান, সকালে মাল ডেলিভারি আছে এবং ভিতরে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিবেন।
পরিকল্পনা অনুসারে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সুমন কারখানার সামনে যান। নিনজা ও রাহাত কৌশলে সুমনসহ তিনজনকে কারখানার ভিতরে নিয়ে যান। তারা প্রথমে নৈশপ্রহরী আবদুল হান্নানকে কৌশলে কারখানার উত্তর পাশে সেপটিক ট্যাংকির কাছে নিয়ে যান। লোহার রড দিয়ে মাথার পেছনে সজোরে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই হান্নানের মৃত্যু হয়। গলায় কাপড় দিয়ে ফাঁস দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর লাশ সেপটিক ট্যাংকের ভিতরে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর তারা অপর নৈশপ্রহরী সামসুল হককে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সেখানে নিয়ে একই কায়দায় হত্যা করেন ও লাশ একই সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেন। রডটিও সেখানে ফেলে দেওয়া হয়।
হত্যা ও লাশ গুমের পর ট্রাকচালক নিনজা নিহত হান্নানের মোবাইল ফোন সুমনকে দেন এবং তাকে গাজীপুর চলে যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খুদেবার্তা নিহতদের পরিবার ও কারখানার মালিককে পাঠিয়ে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করতে বলেন। এছাড়া নিনজা ও রাহাত বগুড়া সামলাবেন বলে জানিয়ে দেন।
সুমন ওই মোবাইল ফোনটি গাবতলীর একটি পুকুরে ফেলে দিয়ে শুধু সিম নিয়ে গাজীপুরে চলে যান। তিনি সেখানে গিয়ে নিহত হান্নানের সিম ব্যবহার করে তার পরিবার ও কারখানা মালিকের কাছে ইংরেজিতে খুদেবার্তা পাঠিয়ে মুক্তিপণের নাটক মঞ্চস্থ করেন।
শুক্রবার বিকালে কারখানার শ্রমিকরা সেপটিক ট্যাংকে হান্নান ও সামসুলের লাশ দেখতে পান। পরে পুলিশ লাশ দুটি উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। এ ব্যাপারে নিহত হান্নানের স্ত্রী হিরা বেগম সদর থানায় অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
পুলিশ সুপার জানান, জোড়া খুনের ঘটনা তারা গুরুত্বের সঙ্গে নেন এবং অনুসন্ধান শুরু করেন। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তারা আসামি সুমনের অবস্থান নিশ্চিত হন। ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি চৌকস টিম গাজীপুর থেকে সুমনকে গ্রেফতার করে। তার কাছে নিহত নৈশপ্রহরী হান্নানের মোবাইল ফোনসহ দুটি ফোন জব্দ করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বগুড়ার বিভিন্ন স্থান থেকে রাহাত ও নিনজাকে গ্রেফতার করা হয়।
এরপর হত্যায় ব্যবহৃত লোহার রডটি কারখানার সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নিনজা, রাহাত ও সুমন দুই নৈশপ্রহরীকে হত্যার দায় স্বীকার এবং কারণ প্রকাশ করেন।
গ্রেফতার তিনজন বলেন, কারখানার মালামাল বেশি নেওয়ার ঘটনা ফাঁস হওয়ার আশঙ্কায় তারা পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া অপর দুজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। গ্রেফতারের স্বার্থে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করা হবে না। এদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
নিহত নৈশপ্রহরী আবদুল হান্নান বগুড়া সদরের নামুজা ইউনিয়নের বড় সরলপুর গ্রামের আবদুল জোব্বারের ছেলে এবং সামসুল হক শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থা প্রতাপপুর গ্রামের মৃত হাসু আলীর ছেলে।
এদিকে চাঞ্চল্যকর এ জোড়া খুনের মামলা ডিবি পুলিশকে হস্তান্তর করা হয়েছে।