রাজনৈতিক কার্টুনের সংখ্যা কমেছে। অতীতে দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে গড়ে সপ্তাহে সাত থেকে আটটি কার্টুন ছাপানো হতো, তবে বর্তমানে তা অর্ধেকেরও কম হয়। এছাড়াও ছিল সাপ্তাহিক রম্য ম্যাগাজিন। তাও পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
কার্টুনিস্টরা বলছেন, কার্টুনের সংখ্যা সাধারণত রাষ্ট্রের সংকট ও জাতীয় ইস্যুর কারণে বাড়ে বা কমে। ইস্যু থাকলে অবশ্যই কার্টুন বাড়বে। আর কার্টুনের ভাষা বুঝতে না পারাও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদেরও সংকট রয়েছে। তাই তারা ভুল প্রতিক্রিয়া দেখায়। কার্টুন, ক্যারিকেচারের নিজস্ব একটি ভাষা আছে। এই ভাষা সবাই বুঝতে পারে না। অনেকে ব্যঙ্গাত্মক ভেবেই তাদের প্রতিক্রিয়া দেখান। কিন্তু মূল অর্থ বা ভাব তারা বুঝে না। কার্টুনের রসবোধের মধ্য দিয়ে একটি অর্থ বুঝতে হয়, সেটার অনুপস্থিত রয়েছে। অতীতে রাজনীতিবিদরা অনেক অভিজ্ঞ ছিলেন, তারা এগুলো সহজেই নিতেন। বর্তমানে সহনশীলতার মাত্রাও কমেছে।
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর কার্টুন ও কার্টুনিস্টদের কর্মক্ষেত্র নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা হচ্ছে। কার্টুন প্রকাশ ও প্রচার নিয়ে দেশের কার্টুনিস্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে জাতীয় ইস্যু থাকলে কার্টুন হবেই। তবে কার্টুন প্রকাশ ও প্রচার কেবল কার্টুনিস্টদের ওপর নির্ভর করে না। সম্পাদকীয় নীতিমালা, জাতীয় ইস্যু ও রাজনৈতিক সহনশীলতার উপর নির্ভর করে।
বর্তমানে দেশে কার্টুন ও কার্টুনিস্টদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে খ্যাতনামা কয়েকজন কার্টুনিস্টদের সঙ্গে কথা হয়। যারা মনে করেন রাজনৈতিক কার্টুনের সংখ্যা কমেছে। তবে নিয়মের মধ্যে থেকে এখনও করা যায়।
বাংলাদেশ কার্টুন অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ও খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক কার্টুনের সংখ্যা হয়তো কমেছে, তবে এখানে কোনও চাপ রয়েছে সেটা বলা যাবে না। কারণ অনেকে নিয়মিত করছে। মূল বিষয়টা হলো দক্ষতার। তরুণ কার্টুনিস্টরা যে কাজটা করলেন সেটার মধ্যে যদি রসবোধ না থাকে তাহলে সেটা তো কার্টুন হলো না। কার্টুন আঁকার মধ্যে অর্থ থাকতে হবে। একজন নেতা বা নেত্রীর ছবি আঁকলাম তিনি রেগে গেলেন তাহলে সেটা তো কার্টুন বলা যায় না। সেটাতে খোঁচা থাকবে কিন্তু অর্থ থাকতে হবে। আমরা করছি। এখানে নিজেদের সেন্সরশিপ বেশি কাজ করছে। কার্টুনের নিজস্ব ভাষা আছে। সেই ভাষা সার্বজনীন, তা প্রত্যেকের কার্টুনে থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘অনেকে এই পেশায় ভবিষ্যৎ দেখছেন না, গণমাধ্যমগুলো কার্টুনিস্টদের যে পদবী দেওয়ার কথা তাও দেয়নি। সেজন্য অনেকে বেটার অপশন পেয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। অনেক সিনিয়র কার্টুনিস্টও চলে গেছেন, এজন্য কথাবার্তা হচ্ছে। তবে এসব শুধু রাজনৈতিক কারণে হয়েছে আমার তা মনে হয় না। আমি দীর্ঘদিন ধরে পত্রিকা করছি, আমরা কাছে কখনই চাপ মনে হয়নি।’
বাংলাদেশ কার্টুন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও কার্টুনিস্ট জাহিদ হাসান বেনু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশে অতীতে অসংখ্য রাজনৈতিক কার্টুন হয়েছে। তবে বর্তমানে কার্টুন কমেছে। বিভিন্ন কারণেই কমেছে। রাজনৈতিক সহনশীলতা আমাদের কমেছে। এছাড়াও পত্রিকাগুলো আগে যে রম্য ম্যাগাজিন করতো সেখানে সপ্তাহে অসংখ্য কার্টুন ছাপা হতো। সেটাও বন্ধ করা হয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক কার্টুন ছাপা হতো না, সেগুলো বন্ধ হয়েছে হয়তো পত্রিকার অর্থনীতির কারণে। এরকম অসংখ্য কারণ রয়েছে। পত্রিকার ম্যানেজমেন্টও আগের মত কার্টুন ছাপাতে চায় না। পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে ভেতরের পাতায় চলে গেছে কার্টুন। এছাড়াও ডিজিটাল অ্যাক্টের কারণে কার্টুনিস্টদের পরিবারও রাজনৈতিক কার্টুন না করতে উৎসাহ করে।’
কার্টুন ছাপা হওয়ার পর বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে কখনো কখনও কার্টুনের অর্থ ভিন্নভাবে উপস্থাপন হয় এটাও একটি সংকট বলে মনে করেন এই কার্টুনিস্ট। তিনি বলেন, ‘আমাদের কার্টুনিস্টদেরও দক্ষতার অভাব রয়েছে আবার যাদের নিয়ে কার্টুন করা হয় তাদেরও বোঝার ভুল রয়েছে।
রাজনৈতিক কার্টুন কমে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ কার্টুন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নানাভাবে কার্টুন ছাপা হয়। কমিক স্ট্রিপ, পকেট কার্টুন, ইলাস্ট্রেশন ইত্যাদি। তবে পলিটিকাল কার্টুন ইস্যুর ওপর নির্ভর করে। যেমন আমি সারাবাংলায় মনের মত ইস্যু পেলেই আঁকি। কোনও মাসে কয়েকটা আবার কোনও মাসে একটাও না। অতীতে কার্টুন তো পত্রিকার একটা অংশই ছিলে বলা চলে। কার্টুন কিন্তু অনেকেই ছাপেন। তবে পলিটিকাল কার্টুন এখন কমই হয়।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এটা বলা মুশকিল। পত্রিকাগুলো অনেক ক্ষেত্রে কার্টুন ছাপছেন না। আবার কার্টুনিস্টরা আঁকছেন নানান কিছু মাথায় রেখে সেন্সর করে। মানে আগের মত ধুমধাম নির্বাচিত বিষয় এখন কমে গেছে বলা যায়। এছাড়াও রাজনৈতিক সহনশীলতাও কমেছে। সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতা কমেছে বলা যায়। কার্টুনকে কার্টুন হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা কমেছে।’
বর্তমান পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য অ্যাসোসিয়েশন কোনও কাজ করছে কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ নিয়ে সাংগঠনিকভাবে কথা হয় না। আসলে সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিলো আমরা প্রফেশনাল কার্টুনিস্টরা একত্র হওয়া এবং সবাই মিলে নিয়মিত প্রদর্শনীর আয়োজন ইত্যাদি করা। এখনও সংকট নিয়ে ওভাবে ভাবছি না। কারণ চাইলেই কিছু নিয়মের মধ্যে থেকে সেন্সর করে কার্টুন করা যায়।’
ধর্মীয় অনুভূতিসহ বিভিন্ন কারণে কার্টুন করা এখন সবার জন্যই চ্যালেঞ্জিং উল্লেখ করে কার্টুনিস্ট বিপ্লব চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের কার্টুনের আইডিয়া রয়েছে তবে পত্রিকার চাহিদার সঙ্গে সংখ্যা নির্ভর করে। পত্রিকা চাহিদা থাকলে সেভাবেই করে থাকি।’
বর্তমানে সপ্তাহে তিনটি কার্টুন করেন বলে জানিয়েছেন নিউ এজ পত্রিকার কার্টুনিস্ট মেহেদী হক। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কার্টুন আমরা নিউ এজে করছি। নিয়মের মধ্যে করা যায় তবে বিভিন্ন সেন্সরের বিষয়ে রয়েছে।’
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ২০২০ সালের ৫ মে থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৫ মার্চ দীর্ঘ ১১ মাস কারাভোগের পর ছয় মাসের জামিনে কারাগার থেকে বের হন তিনি।
এর আগে, ২০২০ সালের ৫ মে র্যাব-৩, সিপিসি-১ এর ওয়ারেন্ট অফিসার মো. আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে মিনহাজসহ ১১ জনের নামে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা করেন। এছাড়াও মামলায় অজ্ঞাত আরও ৫/৬ জনকে আসামি করা হয়। ওই রাতে করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে গ্রেফতার করে র্যাব-৩। পরে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা র্যাবের মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়।