।। মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা ।।
স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ যে সময়টা রোপিত হয়েছিল তা হল বাঙ্গালির ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সেই সময় রাজধানীর বাইরে যারা এই ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সংগঠতি করেছিলেন তাদের অন্যতম একজন হলেন খুলনার সর্বজন শ্রদ্ধেয় নুরুল ইসলাম দাদু। গত ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর অনেকটাই নিরবে চলে গেছেন তিনি।
এম নুরুল ইসলাম দাদু ভাই ১৯৩৪ সালের ২ মে খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা খাদেম আহমেদ পেশায় চিকিৎসক ও মাতা আছিয়া খাতুন গৃহিণী ছিলেন। ছয় ভাই বোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন তিনি। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। তিনি ১৯৪৭ সালে কলকাতা মেট্রোপলিটন হাই ইংলিশ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ১৯৪৯ সালে খুলনার বিএল কলেজ থেকে ১৯৪৯ সালে আইএ পাশ করেন।
তিনি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পাস করার পর ছাত্রজীবনে নিখিল বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের খুলনা শাখার সাধারণ সম্পাদক, ১৯৫২ সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত ফ্রন্টে, ১৯৫৭ সালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ন্যাপের খুলনা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬২ সালে খুলনার জাহানাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, ১৯৬৮-৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দান, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন, ১৯৭২ সালে ন্যাপের খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য, ১৯৭৮ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগদান, ১৯৭৯ সালে খুলনা মহানগর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ২০০১ সালে খুলনা-৪ আসন (রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সর্বশেষ তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সবার কাছে ‘দাদু’ নামে পরিচিত ছিলেন।
জীবনের শেষ মুহুর্তে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও কেউ তাকে অসম্মান করতো না। তিনিও কারো সাথে কোন বৈরী আচরন করতেন না। অত্যান্ত ধী সম্পন্ন ব্যাক্তিত্বের অধিকারী দাদু ভাই রাজনীতিতে জুনিয়র কর্মীদের স্নেহ করতেন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে। রাজনৈতিক কোন দল করতেন তা ভাতেন না। ছোটদের রাজনৈতিক নৈতিকতা সম্পর্কে বলতেন।
আমাদের ইতিহাসের প্রয়োজনে নানা বাকে অনেকেই জড়িত থাকেন। যাদের কথা হয়তো আমরা ভুলেই যাই। কিন্তু, ইতিহাসের প্রয়োজনেই তাদের জন্ম হয। তাদের কারণেই ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়। তেমনই খুলনার ইতহাসের এক উজ্জল নক্ষত্রের নাম হচ্ছে দাদু ভাই। খুলনার রাজনীতিতে জনপ্রিয় রাজনীতিক হিসাবে সৈয়দ ঈসার পাশাপাশি অবশ্যই দাদু ভাইয়ের নাম উচ্চারন করতে হবে। সৈয়দ ঈসা’র সাথে দাদু ভাইয়ের সম্পর্ক এতটাই আন্তরিক ছিল যে, আমার নাম ঈসা হওয়ার কারণে তিনি বিশেষ স্নেহ করতেন। যেটা আর কখনো আমি পাবো না।
দাদু ভাই রাজনীতি ছাপিয়ে খুলনার সাহিত্য, সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ব্যাপক পদচারনা রেখেছেন। আবৃতিতে তার কন্ঠ ছিল অসাধারন। বিশাল হৃদয়ের মানুষটি জীবিতাবস্থায় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। প্রায় ৭ দশক সরাসরি রাজনীতির সকল পাটে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন সক্রিয় সংগঠক। সাহিত্যরসিক, প্রবল রসবোধসম্পন্ন দাদু ভাই একইসাথে কয়েক প্রজম্মের মানুষের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন।
ভরা গলার অধিকারী দাদু ভাইয়ের কবিতা আবৃতি মানুষকে মোহিত করতো। যারা তার আবৃতি শোনেননি তারা আসলেই বঞ্চিত হয়েছে। রাজনৈতিক কিংবা সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতি যেখানেই হোক বক্তব্য যে একটা উন্নতমানের শিল্প তা দাদু ভাই প্রমান রেখেছেন।
খুলনার রাজনীতিতে দাদু ভাইকে সবাই সমীহ করতো, সে নিজ দলের হোক বা অন্য দলেরই হোক। খুলনার গণমানুষের এই প্রিয় নেতা এম নুরুল ইসলাম ২১ অক্টোবর ২০২০ সালে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। টুটপাড়া কবরস্থানে তিনি শুয়ে আছেন।
এম নুরুল ইসলাম দাদু ভাইয়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।
[ লেখক : রাজনীতিক, মানবাধিকার সংগঠক, মহাসচিব, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতি]