।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া ।।
কমরেড নুরুল হক চৌধুরী মেহেদী, একজন দেশপ্রেমিক রাজনিতিক ও গরীব মুক্তি আন্দোলনের নেতা। ১১ অক্টোবর ২০২১ তার ৬ষ্ট মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৫ সালের এই দিনে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আমাদের মনে আছে বা মনে থাকারই কথা। এই তো ৮ অক্টোবর ছিল ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। ২/১ টি গণমাধ্যম ছাড়া কেউ এই সংবাদটি প্রকাশ করে নাই আজ ভাষা মতিনের মৃত্যুবার্ষিকী। কমরেড মেহেদরি ক্ষেত্রের তার চাইতে বেশী হবে বলে আমার মনে হয় না। কয়জন জানে তার সম্পর্কে। জমিদার পরিবারের একজন সন্তান সারাটা জীবনে কাটিয়ে দিল একটি শোষণমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
আর কোথাও না হলে বাংলাদেশের দুইটা সামরিক সরকারের সময় তিনি মন্ত্রী হতেই পারতেন। মন্ত্রী হবার জন্য নানা ভাবে তাকে কাছে টানারও চেষ্টা করা হয়েছিল সামরিক শাসকদের পক্ষ থেকে। কিন্তু, না- তা হননি। না হওয়াটাই বোধ করি আজকের সমাজে বোকামি বা বুদ্ধিহীনতা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তবে, এই বোকামিটাই হচ্ছে সততা, রাজনীতির প্রতি প্রতিজ্ঞা এবং আজকের ও আগমীর প্রজন্মের জন্য বেঁচে থাকার অনুপ্রেরনা।
নোয়াখালি জেলার অম্বর নগর গ্রামের চৌধুরী পরিবারে জমিদার ঘরে জন্ম গ্রহন করে আজীবন এই নেতা কাজ করেছেন খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করে ১৯৫৩ সালে বৃহত্তর নোয়খালীর কাজিরহাটে প্রথম শহীদ মিনার করছিলেন তিনি।
ক্ষমতার রাজনীতি কমরেড মেহেদীকে টানতে পারেনি। মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আদর্শ থেকে নিজেকে দূরে সরাতে পারেনি তিনি। সাম্রাজ্যবাদ আর আধিপত্যবাদ বিরোধী রাজনীতি এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে প্রথম সারিতেই থাকতেন তিনি। তার মৃত্যু বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার একজন লড়াকু সৈনিক। কমরেড মেহেদী ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সাধারণ মানুষের মুক্তির আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে জনগনের মুক্তির আন্দোলনে প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের সকল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে তার সোচ্চার ভূমিকার জন্য তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার-নির্যাতনের শিকার হন।
১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহন করা কমরেড মেহেদীর বাবা আলী আকবর চৌধুরী একজন জমিদার হলেও তিনি নিজেকে সাম্যবাদী আন্দোলনে যুক্ত করেন। সে কারণে কৃষক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি এবং কৃষকদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। মওলানা ভাসানী যখন সিরাজগঞ্জ, ভাসানচর, ভরপেটায় কৃষকদের অভাব অভিযোগ নিয়ে ‘কৃষক প্রজা সম্মেলন’ করেন, তখন কমরেড মেহেদীও এই আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত রাখেন। কমরেড মেহেদী কৃষক আন্দোলন করতে গিয়ে সংসার জীবনে আবদ্ধ হননি। রাজনৈতিক জীবনে ১৯৭৫ সালে ২ বছর, ১৯৮৩ সালেসহ একাধিকবার কারাভোগসহ দীর্ঘ এক দশক আন্ডারগ্রাউন্ডে জীবনযাপন করেন। তারপরও বুর্জোয়া রাজনীতিতে লোভের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেননি। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কমরেড মেহেদী বৃহত্তর নোয়াখালী জেলায় অবিভক্ত ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ফাতেমা জিন্নাহ’র নির্বাচনী প্রচারণায় তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক উকিল ও সম্পাদক নুরুল হক মিয়ার সঙ্গে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে এক মঞ্চ থেকে একযোগে কাজ করেন। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন কমরেড মেহেদী।
একজন হার না মানা রাজনীতিকের প্রতিকৃতি কমরেড নুরুল হক মেহেদী। যদিও তার আসল নাম নুরুল হক চৌধুরী। তবে এ নামটি হারিয়ে গেছে “কমরেড মেহেদী” নামটির আঁড়ালে। বাম রাজনীতিতে আত্মগোপন থাকা অবস্থায় ছদ্মনাম ধারণের ঐতিহ্য বহু পুরোনো। সততা, অসামান্য নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের ক্ষেত্রে তিনি নিজেই একটি ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতজনের মাঝে স্বীকৃত।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার অম্বরনগর গ্রামে বনেদী জমিদার আলী আকবর চৌধুরী ও আম্বিয়া খাতুনের পুত্র তিনি। কমরেড মেহেদীর রাজনৈতিক জীবনে বাবার পক্ষ থেকে কিছুটা বিরোধিতা থাকলেও মা আম্বিয়া খাতুনের ভূমিকা ছিল বিপরীত। মায়ের সহযোগীতা তাঁকে খেটে-খাওয়া মানুষের মুক্তির সংগ্রামে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে যুক্ত হন কমরেড মেহেদী।
১৯৫৫ সালে নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। ঐ সময় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন আলী আহমেদ। ১৯৫৬ সালের দুর্ভিক্ষের সময় কমরেড মেহেদীর নেতৃত্বে খাদ্যের দাবিতে নোয়াখালী জেলার কাজীরহাট থেকে সহস্রাধিক লোকের ভুখা মিছিল বের হয়। এই মিছিল ২০ কিলোমিটর পথ অতিক্রম করে মাইজদী ডি.এম. অফিস (বর্তমানে ডি.সি) অফিস ঘেরাও করে।
কমরেড মেহেদী ১৯৫৭ সালে অবিভক্ত ন্যাপের বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের মার্শাল’ ল জারির সাথে সাথে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়। দীর্ঘ ৪ বছর হুলিয়া মাথায় করে কৃষকদের সচেতন ও সংগঠিত করার কাজ করেন। ১৯৬৩ সালে কমরেড মেহেদীর নেতৃত্বে কাজীরহাটে জেলা কৃষক সমিতির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী বক্তৃতা করেন। ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর চুল চুরির প্রচারণাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তাঁর ধাক্কা নোয়াখালীতেও লাগে। লুটপাটের উদ্দেশ্যে দৃষ্কৃতকারীরা চৌমুহনীতে দাঙ্গা বাঁধানোর পায়তারা করে। কমরেড মেহেদী, ডা. রাশবিহারী দাস, চিত্তরঞ্জন দাস, রইচ উদ্দিন আহমেদ ও ডা. নিজামুল হুদা প্রমুখের ন্যাপ নেতাদের উদ্যোগে চৌমুহনীতে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। ফলে জেলায় শান্তি বজায় থাকে।
১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত কমরেড মেহেদী আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নোয়াখালী সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ)-এর ব্যানারে সারা জেলায় শত শত সভা-সমাবেশ করে জনমত গঠন করেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৬ সালে ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বৃহত্তর নোয়াখালীতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৮-৭১ পর্যন্ত সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কর্মসূচী বাস্তবায়নে কৃষকদের সাথে কাজ করেন। এ সময় চরাঞ্চলে তাঁর পক্ষে দিনে এক বেলা খাওয়াও কষ্টকর ছিল। কখনও খাওয়া জুটলেও খেতে হত শুধু খেসারাীর পাতলা ডাল দিয়ে। কোনো কোনো সময় দু’দিনও না খেয়ে থাকতে হয়েছে তাঁকে। চরাঞ্চলে বহুবার জোতদারদের হামলার শিকার হতে হয়েছে কমরেড মেহেদীকে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি দু’বার রাজাকারদের হামলার মুখে পড়েন এবং সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।
স্বাধীনতার পর ভারতীয় অর্থনৈতিক লুণ্ঠন ও তৎকালীন সরকারের শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ ২ বছর কারা নির্যাতন ভোগ করেন। দীর্ঘ ৯ বছর এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটানা আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৮৯ সালে আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘ কারা নির্যাতন ভোগ করেন।
১৯৭৮ সালে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে “গণতান্ত্রিক কর্মী শিবির” নামে একটি দল গঠন করেন। তিনি এ দলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ দলের জন্মলগ্ন থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন শুরু করে। ভারতের কবল থেকে তালপট্টি উদ্ধারের জন্য অসংখ্য মিটিং-মিছিল ও ঘেরাও কর্মসূচী পালন করে। ১৯৮০ সালের ৩০ নভেম্বর তালপট্টি দিবস (পূর্বাশা দিবস) পালন করেন। তালপট্টির উপর ভারতের অযৌক্তিক দাবীর প্রতিবাদে ১৯৮১ সালের ৬ জানুয়ারি ভারতের দূতাবাস ঘেরাও করেন।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কমরেড মেহেদী এখনো গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে সরে আসেননি। এই রাজনীতিক তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই শোষণমুক্তির লড়াইয়ে বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন। রাজনীতিকদের লোভ-লালসার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ঘটনা এদেশে কম নয়। কমরেড মেহেদীকে বলা যায় এদিক থেকে বিরল সৌভাগ্যবানদের একজন। যিনি লোভ-লালসা ও ব্যক্তিগত অর্জনকে উপেক্ষা করার সাহস দেখিয়েছেন। সাধ ও সাধ্যের বৈপরীত্যের কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাঙ্কিত প্রত্যাশা পূরণে বাঁধা সৃষ্টি হলেও তিনি কখনও নিজেকে বিকিয়ে দেননি লোভ-লালসার কাছে, আত্মসমর্পণ করেননি ক্ষমতার কাছে। শোষকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর সামনেও নিজের কর্তব্য কর্ম থেকে বিরত থাকেননি।
একজন সাদা মনের মানুষ মেহেদী ভাইয়ের সাথে কত যে আড্ডা হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। বয়সে তার সন্তানের মত হলেও সম্পর্কটা ছিল খুবই সুন্দর। আদর-স্নেহের কোন কমতি ছিল না। ভালোবাসায় কোন খাত ছিল না।
কমরেড নুরুল হক চৌধুরী মেহেদী’র ৬ষ্ট মৃত্যুবার্ষিকীতে তার অমর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীরতম শ্রদ্ধা।
[ লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন ]