।। মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার ।।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। আবরার হত্যার ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে তাঁর বাবা মামলা করেন । আজ শহীদ আবরারের দ্বিতীয়, মৃত্যু বার্ষিক । আজকের এই দিনে তাহাকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করছি । কিছুদিন আগে বাংলাদেশের প্রথম সারির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাদের পড়ালেখা প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাদের কেউ কেউ ইতিমধ্যেই চাকরি খুঁজতে শুরু করেছে এবং দেখতে পাচ্ছে যে কোনো কোম্পানিই পূর্বাভিজ্ঞতা ছাড়া নিয়োগ দেয় না। সেখানে আমরা যাঁরা ছিলাম, তাঁরা একমত হলাম যে আসলেই বাংলাদেশে চাকরির বাজারে নতুনদের জন্য সুযোগ খুব কম। অধিকাংশ কোম্পানিই কম পয়সায় অভিজ্ঞ কর্মী চায়। তাই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং চাকরির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পলিসিগত পরিবর্তন দরকার। আমি তখন তার সঙ্গে আরেকটু যোগ করে বললাম, বাংলাদেশে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা সহজে চাকরি পায় না, এটা তো বহু বছরের পুরোনো কথা।
এই কথাটাকে সত্যি ধরে নিয়ে শিক্ষার্থীরা কি পড়ালেখার বাইরে আর কোনো দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করছে,যা তাদের চাকরির বাজারে এগিয়ে রাখবে? তারা কি গান গায়, ছবি তোলে, গ্রাফিকস ডিজাইন করতে পারে? মেধাবী শিক্ষার্থীরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই কোনো গবেষণাকাজের সঙ্গে জড়িত হওয়া বা পার্টটাইম কাজ করে? দুঃখজনকভাবেও সত্যি উত্তরটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই‘না’। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা দিনরাত পড়াশোনা করে; কেননা, আমরা বড়রা চাই তারা পড়ালেখা করে হবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের কারোরই অজানা নয় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থা। তারপরও সকাল-সন্ধ্যা শিক্ষাব্যবস্থাকে বকাবকি করতে করতে আমরা আমাদের সন্তানদের এই একটি কাজ করতে বাধ্য করি।
আমাদের সন্তানেরা এভাবে শুধু একটা কাজকে ধ্যানজ্ঞান করে বড় হয় বলেই আবরার ফাহাদের মতো ছেলেরা যারা একটু অন্য রকম হতে চায়, তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। আবরারের মৃত্যুর দায় মোটেই শুধু তাকে যারা মেরেছে তাদের নয়। বরং এই দায় অনেক বেশি পরিমাণে আমার, আপনার, আমাদের বাবা-মায়েদের; যাঁরা মনে করি যে পড়ালেখা করা ছাড়া আমার সন্তান আর কোনো কিছু করবে না। সে বই পড়বে না,গান গাইবে না, কম্পিউটারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নাড়াচাড়া করবে না; কেননা,এসবই ফালতু কাজ। পড়ালেখা এবং কেবল পড়ালেখা করে ক্লাসে নিয়মিত প্রথম হওয়াই হলো সন্তানদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আবরারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কেন পড়ালেখা করার বিষয়টা টেনে আনছি, তা একটু ব্যাখ্যা করি। সবাই আমরা বলছি যে ছেলেগুলো আবরারকে পিটিয়ে মারল, তারা সবাই বুয়েটের ছাত্র। এত মেধাবী হয়ে তারা এ রকম একটা জঘন্য কাজ কীভাবে করল? আচ্ছা বলুন তো,আমরা মা-বাবারা আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা বাদে আর কোনো কাজে মেধা ব্যবহার করার সুযোগ দিই? স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হোক বা পাড়া-মহল্লায় হোক কোথায় ছেলেমেয়েদের মননশীলতা এবং সৃজনশীলতাকে নানামুখী কাজে ব্যবহার করার সুযোগ আছে? বাংলাদেশে এখন যে বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী আছে, তাদের বড় অংশ পর্নো সিনেমা দেখে, ইভ টিজিং থেকে শুরু করে ধর্ষণে জড়ায়, অনেকেই মাদক নেয়। এগুলো তারা করবেই, কারণ তরুণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন মানুষের শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনও বাড়ন্ত হয়। সেই মন আনন্দ চায়, পৃথিবীকে উপভোগ করতে চায়, নিজের মেধাকে নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে চায়। তারুণ্য তার শক্তি প্রদর্শন করতে চায়। খেলাধুলা করতে চায়। কিন্তু আমাদের সমাজে এসব কোনো কিছু করার সুযোগ না থাকায় তরুণেরা গোপনে নিষিদ্ধ কাজে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে নিজের মধ্যে সঞ্চিত তারুণ্যের দীপ্তি ও শক্তিকে প্রদর্শন করার পথ খুঁজতে খুঁজতে নিজের অজান্তেই কেউ কেউ রাজনীতিকে বেছে নেয়। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করার সুবিধা হলো, এটা মা-বাবা টের পান না। অন্য কিছু করতে গেলে তা কোনো না কোনোভাবে মা-বাবার কান পর্যন্ত চলে যাবে। তখন তাঁরা ছেলে নষ্ট হয়ে গেল বলে হায় হায় রব তুলবেন। তাই আমরা দেশের নষ্ট রাজনীতিকে যতই বকাবকি করি, সত্যি কথা হলো, পড়ালেখার পাশাপাশি রাজনীতি করা ছাড়া আমরা তরুণদের জন্য আর তেমন কোনো অপশন খোলা রাখিনি। তাই আমাদের সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে,সেখানে গিয়ে রাজনীতি করা তাদের কারও কারও মনের আনন্দের খোরাক হবে, এটাই স্বাভাবিক। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবরারের মতো ছেলেদের সহ্য করতে পারবে না। কেননা, নষ্ট রাজনীতি তাদের সেটাই শেখাবে।
আবার উল্টো একটা দিকও আছে। আমরা আমাদের সন্তানদের মেধার নানামুখী বিকাশকে তো উৎসাহিত করিই না, বরং আমরা এমনভাবে বেষ্টনীর ভেতর রাখি যে তারা ভীরু, দুর্বল মনের মানুষ হয়ে বড় হচ্ছে। আমাদের মানসিকতা হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবে, অত্যাচারীর বিপরীতে দাঁড়াবে অন্যের ছেলে বা মেয়ে, আমার সন্তানেরা নয়। এই মানসিকতা জাতি হিসেবে আমাদের অনেক পেছনে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ভাবতেই পারি না আমার পুত্র হিমালয় জয় করবে, আমার কন্যা মহাকাশে যাবে। আমরা আমাদের সন্তানদের মুখে লাগাম টেনে ধরে রাখতে চাই, তাদের দুঃসাহসী হতে দিতে চাই না। আমাদের মনে শুধু ভয় আর ভয়। সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের মনের এই অতিরিক্ত ভয় একটা মেরুদণ্ডহীন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করছে। তাদের মধ্যে যারা স্বাধীনচেতা হয়, নিজের মত সজোরে প্রকাশ করে, তারা হয় অন্য রকম। তাদের ভাগ্য আবরারের মতো হলে তাতে তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই।
পৃথিবীতে একমাত্র চিরসত্য সম্ভবত এটাই যে মানুষ একবার জন্ম নেয় আর একবারই মৃত্যুবরণ করে। আমি জানি না আগামীকালই গাড়ি দুর্ঘটনায় আমার মৃত্যু লেখা আছে কি না। কেউ জানে না তার শরীরে কোনো মরণব্যাধি দানা বাঁধছে কি না। একই কথা আমাদের সন্তানদের বেলায়ও প্রযোজ্য। কি লাভ শুধু তাদের পড়ালেখা করতে বাধ্য করে? কত দিন আপনি নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে আপনার সন্তানকে আগলে রাখতে পারবেন?
এমন ছাত্ররাজনীতি চায় না কেউ। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্ররাজনীতির নামে হত্যা–খুন, হানাহানি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, রাহাজানির ধারা চলে আসছে। সম্প্রতি বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যা তারই আরেক নৃশংস রূপ।
এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে ধারায় চলছে, এমন অবস্থায় সুষ্ঠু ধারার ছাত্ররাজনীতি ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির নামে যে ধ্বংসাত্মক ও রক্তাক্ত কর্মকাণ্ড চলছে, তা মানুষ আর নিতে পারছে না। বিশেষ করে, বুয়েটে আবরার হত্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে টর্চার সেল, র্যাগিং ও নানা অত্যাচার–নির্যাতনের যেসব খবর বেরিয়ে আসছে, তা শিউরে ওঠার মতো। বছরের পর বছর এটা চলছে, কেউ এত দিন টুঁ শব্দ করার সাহস পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর কিংবা বিভাগীয় প্রধানেরাও কোনো ব্যবস্থা নেননি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বুয়েট কর্তৃপক্ষ সেখানে ছাত্ররাজনীতি তথা দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ও অনুসরণ করুক—ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনেকেই তা চাইছেন। ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় রাজনীতি তথা ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা যায় কি না, সেই আলোচনাও সামনে চলে এসেছে। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজ এবং প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের ভয়ংকর ছাত্ররাজনীতিকে বিদায় করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজ নিজ সিদ্ধান্তে এটা করতে পারে। একই সঙ্গে ছাত্রদের ন্যায়সংগত দাবিদাওয়ার জন্য ছাত্র সংসদকে কার্যকর ও নিয়মিত নির্বাচন করার উদ্যোগ থাকতে পারে। সরকারকে এ বিষয়ে চিন্তা করতে হবে।
[ লেখকঃ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশকঃ বাংলা পোস্ট বিডি. নিউজ]