করোনাব্যাধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে ৪৮.৪৯ শতাংশ পরিবার থেকে অন্তত একজন কাজ হারিয়েছেন বা কাজ পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কাজ হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন শহরের ৭৩.৩ শতাংশ এবং গ্রামের ৯২.৫ শতাংশ মানুষ। শহরে অস্থায়ীভাবে বসবাসরত মানুষরা গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। তাদের বেশির ভাগ গ্রামে গিয়েও কাজ পায়নি।
পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ফোরাম “ফরমাল রিকগনিশন অফ দ্যা উম্যান’স আনকাউন্টেড ওয়ার্ক” এর উদ্যোগে “২০২০-এ করোনাকালে সংসারের সেবাকাজের দ্রুত বিশ্লেষণ” শীর্ষক এক জরিপে এসব হিসাব পাওয়া যায়। গত বছরের নভেম্বর থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শারমিন্দ নিলোর্মীর নেতৃত্বে এ জরিপ পরিচালিত হয়। এফোরামের সদস্য সংস্থাগুলো এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংস্থা, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, অক্সফাম ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
গতকাল জুমে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় জরিপের তথ্য প্রকাশ করা হয়। এ সময় প্রধান অতিথি হিসাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি ও বিশেষ অতিথি ছিলেন ইউ এন উম্যানের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ সোকো ইশিকাওয়া উপস্থিত ছিলেন। জরিপের উপর আলোচনা করেছেন সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, বিএনপিএস এর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, একশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সারাহ কবীর এবং অক্সফাম উম্যান এমপাওয়ারমেন্ট এন্ড কেয়ার প্রোগ্রামের ম্যানেজার সার হল প্রমূখ। সভাপতিত্ব করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।
জরিপে করোনার কারণে কত মানুষ কাজ হারিয়েছে, দারিদ্রের হার কতটা বেড়েছে, নারীর আয় কতটা কমেছে, ঘরে নারী-পুরুষের কাজের আনুপাতিক হিসাবসহ বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের মধ্যে করোনার কারণে ৭৬শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে। মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করে এমন ৬৮শতাংশের এবং ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করে এমন ৭৩শতাংশ ব্যাক্তির আয় কমেছে। শ্রমজীবি মানুষ বেশি আর্থিক সংকটে পড়েছে। গত বছরের করোনায় সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা পেয়েছে ২২.৯৭ শতাংশ শহরের মানুষ। করোনাকালে নারীদের ওপর ঘরের কাজের চাপ কয়েকগুণ বেড়েছে। করোনার কারণে সৃষ্ট অভাবে পুরুষের তুলনায় নারীর সম্পত্তিই বেশি বিক্রি করা হয়েছে। নারীর কাজ না থাকায় ৭৭.৭৮ শতাংশ নারী প্রধান পরিবার অর্থনৈতিক অনটনে পড়েছে। করোনার মধ্যে ৮৫শতাংশ শহরের নারীর ঘরের কাজে অংশ গ্রহণ ১২৮ শতাংশ বেড়েছে। ঘরের কাজের পাশপাশি স্বামীর যত্ন, সন্তান ও পরিবারের অন্যদের দেখাশোনাও স্বাভাবিক সময়ে ৩ থেকে ৫ ঘন্টা করতে হলেও করোনায় ৭/৮ ঘন্টার বেশি করতে হচ্ছে। নারীদের এসব শ্রম পরিবার ও রাষ্ট্র মূল্যায়ন করছে না। করোনায় ঘরের কাজে পুরুষের অংশ গ্রহণ বাড়লেও নারীর তুলনায় তা সামান্য। করোনাকালে ৩৪.৪ শতাংশ মা সন্তানকে অন লাইনে পড়ালেখা করতে সহযোগিতা করেছে। শুধু গ্রামে ৭.৩শতাংশ বাবা টিভি দেখতে দেখতে তার সন্তানকে টিভিতে অনুষ্ঠিত পড়ালেখা করতে সাহায্য করেছে। উত্তরদাতাদের শতকরা ৮২.৭৮ শতাংশ মনে করে, মহামারি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলেছে। করোনাকালের অর্থনৈতিক সংকটে তাদের মানসিক চাপ বেড়েছে। এতে শারীরিকভাবে নিজেকে দুর্বল মনে করেছে। গ্রামীণ নারী উত্তরদাতাদের মধ্যে ৫০শতাংশই নিজেদের মানসিকভাবে দুর্বল মনে করছে, ২০শতাংশ মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত ভাবছে, শহরের শতকরা ২৩ শতাংশ নারী নিজেকে মানসিকভাবে খুবই দুর্বল মনে করছে। গ্রামের ৯৭শতাংশ ও শহরের ৮৮শতাংশ নারী নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। করোনাকালে ঘুম কমে যাওয়া, ওজন বেড়ে বা কমে যাওয়া, শরীর ও মাথা ব্যথাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বলেন, নারীর অমূল্যায়িত শ্রমকে আসছে অর্থবছরের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। নারী যে প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় কাজ করছে, সেটারও একটা মনিটরিং ভ্যালু বের করতে হবে।