শুক্রবার, তখন ঘড়ির কাঁটা বিকেল ৪টার ঘরে। চট্টগ্রাম থেকে ধুঁকতে ধুঁকতে আসা ‘কর্ণফুলী এক্সপ্রেস’ মেইল ট্রেনটি চলছিল ঢাকার পথে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে ঢোকার মুখে টিএ রোডের গেট পার হতেই ট্রেনটি এমন গতিতে ছুটল, যেন কেউ তাড়া করছে! সপ্তাহ ঘুরতে চলল ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে ট্রেন থামে না। যাত্রাবিরতি নেই, তাই কয়েক দিন ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে এলেই ট্রেন ছুটে চলে দুর্বার গতিতে। এক পলকে ট্রেন চলে যেতে দেখে স্টেশনে দাঁড়ানো সবার বুকে হাহাকার! বেজে ওঠে আক্ষেপের সুর। বলতে শোনা যায়, ‘এমনও দিন এলো, মেইল ট্রেনও আজ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জন্য সোনার বাংলা-সুবর্ণ হয়ে গেল।’
দুই. পৌর এলাকার পথে পথে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। অপরিচ্ছন্ন পুরো শহরের রাস্তাঘাট। বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহও বন্ধ। পৌর এলাকার অন্তত ১০ স্থানে ময়লার বড় বড় স্তূপ। হেফাজতের তাণ্ডবের পর পৌর কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। ময়লা অপসারণের মতো সক্ষমতা এই মুহূর্তে পৌরসভার নেই। ময়লা সরানোর জন্য যেসব গাড়ি ব্যবহার করা হতো, সেগুলো ২৮ মার্চের তাণ্ডবের সময় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সাত দিন হয়ে গেল পৌর কার্যালয়ে তালা, তাই নাগরিক সব সেবা এখনো বন্ধ।
তিন. ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর আর সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন মতিন মিয়ার ‘দ্বিতীয় সংসার’। বলা চলে, দুই মিলনায়তনই তাঁর অন্ধ ভালোবাসার নাম। এক সপ্তাহ আগেও দিনের পুরোটা সময় কাটত মিলনায়তনের আঙিনায়। এখন সেখানে গিয়ে শুধু চোখের জল ফেলে সমাধানের পথ খোঁজেন। গত ২৮ মার্চ হেফাজতের হরতালে কপাল পোড়ে মতিন সাউন্ড সিস্টেমের মালিক আব্দুল মতিন মিয়ার। সেদিনের তাণ্ডবে ওই দুই মিলনায়তনে থাকা তাঁর কমপক্ষে ১৮ লাখ টাকার মালপত্র ছাই হয়ে যায়। পুড়ে যাওয়া স্থানে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মতিন মিয়া বলেন, ‘রোজগারের মাধ্যম পুড়িয়ে দেওয়ায় আমি এখন নিঃস্ব। আমার সংসারে এখন খাবার নেই। বন্ধুদের থেকে চেয়ে সংসার চালাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না।’
সব কিছু মিলিয়ে এখন এক অচেনা শহরের নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আগে কেউ কখনো দেখেনি এমন চেহারার শহর। হেফাজতের তাণ্ডবের পর সব কিছুই এখনো এলোমেলো। এক সপ্তাহ ধরে তালাবদ্ধ ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর কার্যালয়। সেই সঙ্গে বন্ধ প্রতিদিনের সেবা কার্যক্রম। বিশেষ করে বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ না করা ও সড়ক, ড্রেন পরিষ্কার না করায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। পৌরসভার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ক্ষতির বিষয়গুলো দেখে না যাওয়া পর্যন্ত সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে। পৌরসভার পক্ষ থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে। তবে এত বেশি ক্ষতি তুলে ধরায় এ নিয়ে নানা আলোচনাও শুরু হয়েছে।
পৌরসভার যত ক্ষতি : ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার ক্ষতির বিষয়ে গতকাল শনিবার দুপুরে পাইকপাড়ার নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন পৌর মেয়র নায়ার কবির। এ সময় মেয়রের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পৌর সচিব মো. শামসুদ্দিন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তাণ্ডবে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
kalerkanthoস্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক তালিকায় বিভিন্ন গাড়ি পুড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় আড়াই কোটি টাকার তিনটি রোডরোলার, ৩৫ লাখ টাকার মশক নিধন গাড়ি, ১৪ লাখ টাকার ২০টি রিকশা-ভ্যান, ভাণ্ডারে রক্ষিত তিন কোটি টাকার খুচরা যন্ত্রাংশ, বিভিন্ন ডকুমেন্ট পুড়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে পৌরসভার মালিকানাধীন সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তনের ছয় কোটি টাকার ভবন, ১১ লাখ টাকা মূল্যের ৫৫০টি চেয়ার, ১০ লাখ টাকার ২০ সেট সোফা, এক কোটি টাকা মূল্যের ২০টি পাঁচ টনের এসি, ৩০ লাখ টাকা মূল্যের ১০টি দুই টনের এসি, ছয় লাখ টাকা মূল্যের ১৫০টি সিলিং ফ্যান আগুনে পুড়ে যায়।
পৌর কর্তৃপক্ষের দাবি করা মোটা অঙ্কের ক্ষতির কথা জেনে অনেকেই এ নিয়ে সমালোচনা শুরু করেছে। সুধীসমাজের একাধিক প্রতিনিধি বলেছেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবেই অতিরিক্ত ক্ষতি দেখানো হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে জাফরুল্লাহ : হেফাজতের কর্মী-সমর্থকদের চালানো তাণ্ডবের ঘটনায় এবার পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে তিনি বলেছেন, ‘আজকে আমি শহরে (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ঢোকার আগেই তারা (পুলিশ) খোঁজ নিচ্ছে আমি কোথায় যাব না যাব। এতটা সচেতন আছে পুলিশ। সেই পুলিশ কিভাবে এত বড় ঘটনার খবর জানল না।’
জাফরুল্লাহ দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এ সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘মোকতাদির চৌধুরী (স্থানীয় সংসদ সদস্য) সরাসরি পুলিশকে ব্লেইম করেছেন। এই মুহূর্তে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। শুধু দুঃখ প্রকাশ করতে পারি। প্রেস ক্লাব পবিত্র একটি জায়গা। সাংবাদিকদের কাজ সত্য তুলে ধরা, আপনারা অনেক জায়গায় সেটি করে যাচ্ছেন।’
এ সময় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের মহাসচিব শেখ রফিকুল ইসলাম ও প্রেসিডিয়াম সদস্য নাঈম জাহাঙ্গীর, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইশতিয়াক আজিজ, ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, পানি বিশেষজ্ঞ ম ইনামুল হকসহ প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রেস ক্লাব নেতাদের পরিদর্শন : জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেছেন, ‘সাংবাদিক সমাজের মধ্যে বিভক্তি আছে বলেই দুষ্কৃতকারী-মৌলবাদীরা হামলার সাহস পায়। না হলে সাংবাদিকরা কেন টার্গেট হবে? কেন সাংবাদিকদের গাড়ি পোড়াবে? আগে তো কখনো এমন ঘটেনি। পেশার কাজে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’ গত শুক্রবার দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত মতবিনিময়সভায় ফরিদা ইয়াসমিন এসব কথা বলেন। ফরিদা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে জাতীয় প্রেস ক্লাবের একটি প্রতিনিধিদল হেফাজতের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব পরিদর্শনে আসে।
এদিকে হেফাজতের তাণ্ডবের জন্য প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক তাণ্ডব চালায় হেফাজতের কর্মী-সমর্থকরা।