কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শনিবার (২ নভেম্বর) যে কোনো মূল্যে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। এদিকে, পতিত সরকারের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টির এ সমাবেশসহ যে কোনো কর্মসূচি প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা। তারা জাতীয় পার্টির সমাবেশস্থলের কাছাকাছি সময়ে প্রতিরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
অন্যদিকে, রাজধানীতে সব ধরনের সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা এখন মুখোমুখি। ইতোমধ্যে কাকরাইলে জাপার কার্যালয়ে ফের অবস্থান নিয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। তারা কার্যালয়ের সামনে শোডাউন করছেন। জাপার নেতারা বলেছেন, ‘বৃহস্পতিবার সেমিফাইনাল খেলা হয়েছে। শনিবার হবে ফাইনাল খেলা।’
অন্যদিকে, যে কোনো সময় দলবদ্ধ হয়ে আবারও জাপার কার্যালয় দখলে নিতে পারে ছাত্র-জনতা।
দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। যে কোনো সময় আবারও সংঘর্ষ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) বিকেলে কাকরাইল এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শনকালে এমন চিত্র দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামীকালের সমাবেশ সফল করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জাতীয় পার্টি। ইতোমধ্যে সমাবেশের জন্য পুলিশ অনুমতি দিয়েছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব নেতাকর্মীদের বিকেল থেকে সমাবেশ সফল হওয়া পর্যন্ত কাকরাইল কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের অবস্থান করার নির্দেশ দিয়েছেন। শুক্রবার বিকেল ৩টার পর থেকে জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীরা আসতে শুরু করেছেন।
শুক্রবার রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে অবস্থান নেন দলটির নেতাকর্মীরা
দলীয় সাবেক এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি, প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফা আল মাহমুদ, কেন্দ্রীয় নেতা সোলায়মান সামীসহ নেতাকর্মীরা এসেছেন। প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর সিকদার লোটন, এমরান মিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ রাজু, আহাদ চৌধুরী শাহিন, আবুল খায়ের, মাহমুদ আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক হেলাল উদ্দিন, এবিএম লেয়াকত চাকলাদার, যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক নুরু, নির্বাহী সদস্য রেজাউল করীম, মাসুদুর রহমান চৌধুরী, সোলায়মান সামি, সোহেল রহমান রেজাউল করিম, আল আমিন, যুবনেতা জিল্লুর, অয়ন, ছাত্রসমাজের যুগ্ম আহ্বায়ক নাজমুল হাসান, সদস্য সচিব আরিফ আলীসহ ২ শতাধিক নেতাকর্মী দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছেন। নেতাকর্মীরা কিছুক্ষণ পরপর মিছিল করে শোডাউন দিচ্ছেন।
বিকেলে লোটন ও হেলালের নেতৃত্বে একটা মিছিল বের করা হয়। তারা দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নিয়ে দলীয় শক্তির জানান দিচ্ছেন।
সন্ধ্যার দিকে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক মীর আব্দুস সবুর আসুদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, রেজাউল ইসলাম ভুইয়া, লিয়াকত হোসেন খোকা, আরিফ খানসহ সিনিয়র নেতাদের আসার কথা রয়েছে।
জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য বারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেছেন, বিনা কারণে জাতীয় পার্টির অফিসে হামলা করা হয়েছে। তারা কী কারণে হামলা করল? এত বড় ঘটনা ঘটলো, পুলিশ কী করেছে? এ হামলার দায় সরকার এড়াতে পারে না।
তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বিশ্বাস করে না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কাল আমাদের সমাবেশ করব। এজন্য সবার সহযোগিতা কামনা করি।
জাপার চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের নির্দেশে নেতাকর্মীরা পার্টি অফিসে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন দলটির নির্বাহী সদস্য সোলায়মান সামী।
এর আগে শুক্রবার দুপুরে বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের পাল্টা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শনিবার কাকরাইলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
এ সময় তিনি দলীয় অফিসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার হামলা ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘দুই তারিখ আমাদের সমাবেশ কর্মসূচি চলবে। আমাদের কর্মসূচি ও আন্দোলন সবই চলবে নিয়মতান্ত্রিক এবং অহিংসভাবে।’
জিএম কাদের বলেন, ‘আমরা মরতে এসেছি, আমরা মরতে চাই। কত মারবে তোমরা, আমরা দেখতে চাই। তারপরও আমাদের সমাবেশ হবে।’
তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের প্রটেকশন দিচ্ছে বলে এখনো বেঁচে আছি, অন্য কারও প্রটেকশনে নয়। বিচারের জন্য যদি আল্লাহর সাহায্যের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, তাহলে দেশ কীভাবে চলবে? আমরা এক দিনের ডেমোক্রেসি চাই না। সব সময়ের ডেমোক্রেসি চাই। আমরা চাই, সরকার হবে অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করে জিএম কাদের বলেন, ‘তারা যা বলে, তা-ই সঠিক; বাকি সবাই ভুল। তারা এখন বিচারকার্যেও বাধা দেয়। তাদের ইচ্ছা হলো, আমাদের অফিস ভেঙে দিয়ে গেল। কারও যদি ভুল হয়, সেখানে ব্যবস্থা নেওয়ার অনেক উপায় আছে। তাই বলে তাকে ধ্বংস করে দেবেন, এটা কেমন হবে?’
জিএম কাদেরের এ ঘোষণার পর শুক্রবার (১ নভেম্বর) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতা। তারা বেলা ১১টার দিকে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে শনিবার একই সময়ে গণপ্রতিরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন।
শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সংবাদ সম্মেলন করে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতা
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জাতীয় পার্টির ডাকা শনিবারের সমাবেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পুনরুত্থানের পরিকল্পনার অংশ। এই অপতৎপরতা বন্ধের জন্যই ছাত্র-জনতা জেগে উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় পার্টির সব কার্যালয়ের সামনে শনিবার বেলা ১১টায় গণপ্রতিরোধ কর্মসূচি পালন করবে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতা।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে টিএসসিতে সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনটি।
সংবাদ সম্মেলনে জাপার নেতাদের উদ্দেশে ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, জাপার আগামীকালের (শনিবার) সমাবেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতি পুনরুত্থানের পরিকল্পনার অংশ। এই অপতৎপরতা বন্ধের জন্যই ছাত্র-জনতা জেগে উঠেছে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছে না। সরকারকে আওয়ামী লীগ, জাপাসহ তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। অবিলম্বে এই রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ করতে হবে, যাতে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে৷
ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বলেন, ডিএমপি কমিশনারসহ সবার প্রতি আহ্বান—আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ তাদের দোসরদের রাজনৈতিক সমাবেশের অনুমতি দেবেন না।
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করলে সরকারের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করা হবে বলে হুঁশিয়ার করেন ইয়ামিন মোল্লা।
সংবাদ সম্মেলনে জাপাকে হুঁশিয়ারি দেন বৃহস্পতিবার আহত হওয়া ছাত্রনেতা মশিউর রহমান। তিনি বলেন, বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পতিত সরকারের দোসর জাতীয় পার্টিকে কোথাও নামতে দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক রিফাত রশিদসহ অনেকেই আগামীকাল জাপাকে প্রতিরোধ করতে বলেছেন।
পতিত সরকারের দোসর হিসেবে বাংলাদেশে জাতীয় পার্টির রাজনীতি করার কোনো অধিকার সেই বলে মন্তব্য করেছেন গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ।
তিনি বলেন, জাপাকে কোনো প্রকার কর্মসূচি পালন করতে দেবে না ছাত্র-জনতা। আমাদের কাছে খবর আছে, জাতীয় পার্টির কর্মসূচিতে পতিত স্বৈরাচারের পলাতক নেতাকর্মীরা ছদ্মবেশ ধারণ করে অংশ নেবেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের এ বিষয়ে যোগাযোগও হয়েছে। না হলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র- জনতার প্রতিরোধের মুখে তারা কর্মসূচি দেওয়ার সাহস পায় কী করে? এত লোক আনবে কোত্থেকে?
তিনি দেশবাসীকে পতিত সরকারের দোসর জাতীয় পার্টিকে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান।
এর আগে জাতীয় পার্টি শনিবার (২ নভেম্বর) দুপুর ২টায় রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা দিলে প্রতিরোধের ডাক দেয় ছাত্র-জনতা। তারা আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টিকে কোনো ধরনের সমাবেশ করতে না দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিলে জাতীয় পার্টি কর্মসূচি পালনের পাল্টা চালেঞ্জ দেয়। পাল্টাপাল্টির কর্মসূচির একপর্যায়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টির কাকরাইল অফিসে জাপা নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা জাপার অফিসে আগুন দেয় ও ভাঙচুর চালিয়ে অফিস দখলে নেয়। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নেয়।