সপ্তাহ পর ৮ এপ্রিল শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ডোজের টিকাদান কার্যক্রম। এর এক দিন আগে বন্ধ করা হবে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দ্বিতীয় ডোজ দ্রুত শেষ করা এবং শৃঙ্খলা রক্ষার কৌশল হিসেবেই এই সিদ্ধান্ত। তবে বাস্তবে এর বড় কারণ হচ্ছে টিকার ভবিষ্যৎ সংকট। আর সেই সংকট সমাধানে দ্রুত কোনো সহজ পথের দেখা মিলছে না। সরকারি চুক্তির আওতায় গত প্রায় দুই মাসে আরো কমপক্ষে এক কোটি ডোজ টিকা দেশে আসার কথা থাকলেও তা আসেনি।
এ পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় কিনে আনা ৭০ লাখ ডোজ আর ভারত সরকারের উপহার হিসেবে দেওয়া ৩২ লাখ ডোজ টিকা এসেছে সরকারের হাতে, যার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ৫৩ লাখ ৭০ হাজার ৪৩১ জন; অর্থাৎ তাঁদের দ্বিতীয় ডোজ দিতে একই সংখ্যক টিকা লাগবে। কিন্তু এখন (গতকাল বিকেল) পর্যন্ত হাতে আছে ৪৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৬৯ ডোজ। ফলে এখনই ঘাটতি হয়েছে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৮৬২ ডোজ টিকার। আগামী ৫ এপ্রিল পর্যন্ত যদি প্রথম ডোজ চালানো হয় তবে হাতে থাকা টিকা থেকে আরো তিন লাখ ডোজের কাছাকাছি টিকা কমে যাবে। ফলে ঘাটতি আরো বাড়বে। ঘাটতি যত বাড়ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকাসংক্রান্ত দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তাও বাড়ছে।
যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘চেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে আরো টিকা এসে যাবে। তখন আর সমস্যা থাকবে না।’
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (টিকাদান) ডা. শামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম ডোজের টিকা চলবে। এর আগে যদি কোথাও কোনো সেন্টারে হাতে থাকা টিকা শেষ হয়ে যায় তবে সেখানে ওই দিন পর্যন্ত প্রথম ডোজ শেষ করে দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় থাকতে হবে, আমরা তাদের কাছে দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাঠাব। আর ৫ এপ্রিলের পরে কোনো কেন্দ্রের হাতে আরো টিকা থাকলে তা দ্বিতীয় ডোজের জন্য রেখে দিতে হবে। ৮ এপ্রিল থেকে একযোগে সারা দেশে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হবে।’
এসএমএস যাবে : ডা. শামসুল হক বলেন, যাঁরা প্রথম ডোজ পেয়েছেন তাঁরা আগের সিদ্ধান্ত অনুসারেই দুই মাস পরে নির্ধারিত দিনে দ্বিতীয় ডোজ টিকা পাবেন। ৮ এপ্রিল দ্বিতীয় ডোজ শুরুর দু-এক দিন আগে যাঁর যাঁর মোবাইল ফোন নম্বরে এসএমএস যাবে, এ ছাড়া প্রথম ডোজের ফরমের অবশিষ্ট অংশ নিয়ে গেলেও হবে। যাঁর যেদিন তারিখ আছে তার দু-এক দিন আগে এসএমএস যাবে।
আসেনি এক কোটি ডোজ কেনা টিকা : গত প্রায় দুই মাসে সরকারি চুক্তির আওতায় আরো কমপক্ষে এক কোটি ডোজ টিকা দেশে আসার কথা থাকলেও তা আসেনি। আগামী জুনের মধ্যে এই চুক্তির আওতায় মোট তিন কোটি ডোজ টিকা দেশে আসার কথা রয়েছে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে। দেশে আসা সব টিকাই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ফর্মুলায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি। ডা. শামসুল হক বলেন, ‘আবার কবে টিকা আসবে, তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নই। নতুন কোনো দিনক্ষণ এখন পর্যন্ত আমি জানি না।’
অন্যদিকে ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘যত বেশি মানুষকে একই সময়ে টিকা দেওয়া যাবে ততই ভালো ফল পাওয়া যাবে, কিন্তু এত টিকা একসঙ্গে পাওয়া সম্ভব নয়। অন্য দেশগুলোও চাহিদা অনুসারে টিকা পাচ্ছে না। আমরা ১৭ কোটি মানুষের দেশ, এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ টিকা দিতে পেরেছি তা একেবারেই কম।’
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের টিকা নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সূত্র থেকে জানা গেছে, মাঝেমধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে অন্য টিকা দেশে আনার আহ্বান জানানো হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এ পর্যন্ত ছয়টি বেসরকারি কম্পানি পাঁচটি টিকা সরকারি ব্যবস্থাপনার বাইরে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আবেদন করেছে সরকারের কাছে। একটি কম্পানি সরকারি ব্যবস্থাপনার বাইরে সেরাম থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১০ থেকে ১৫ লাখ ডোজ টিকা আনার প্রক্রিয়া শুরু করলেও তা থেমে যায়। অন্যদিকে মডার্নার পাঁচ-ছয় লাখ ডোজ টিকা আনার জন্য আবেদন করে রেখেছে আরেকটি কম্পানি। চীনের টিকা আনতে বাংলাদেশে কর্মরত চীনা বিভিন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। পাশাপাশি দেশীয় একটি প্রাইভেট কম্পানি রাশিয়া ও চীনের টিকা প্রাইভেট মার্কেটের জন্য আমদানির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে উৎপাদনেরও আবেদন করেছে। এ ছাড়া ফাইজার ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা আনতেও আগ্রহ প্রকাশ করে রেখেছে দুটি দেশি কম্পানি। তবে সব আবেদনের ব্যাপারেই সরকারের পক্ষ থেকে চলছে রাখঢাক অবস্থা। সর্বশেষ চলতি মাসের শুরুর দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক একটি কম্পানির টিকা উৎপাদন প্লান্ট পরিদর্শনে যাওয়ার পর দেশে টিকা উৎপাদনের সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল, কিন্তু পরে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
অন্যদিকে কয়েকটি টিকার ট্রায়াল নিয়েও উদ্যোগ হতে হতেও থেমে গেছে। দেশীয় কম্পানি গ্লোব বায়োটেকের টিকার ট্রায়ালের বিষয়টি আলোর মুখ দেখছে না অনেক দিন ধরে। টিকা আমদানির জন্য আবেদন করা একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে তাঁদের নিজ নিজ আগ্রহে টিকা আনার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। তবে নিয়ম অনুসারে এ জন্য অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। কিন্তু ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে যোগাযোগ করে এখন পর্যন্ত তাঁরা কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। আবার মন্ত্রণালয় থেকে আবেদনগুলো ঔষধ প্রশাসনের কাছে যাচ্ছে না। ফলে তাঁরা একধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন।
একটি কম্পানির প্রতিনিধি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যে টিকা দেশে আনার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি, সেই টিকার উদ্ভাবক ও উৎপাদক কম্পানি আমাদের এখনই টিকা পাঠাতে রাজি। সরকার যদি অনুমোদন দেয় তবে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই কমপক্ষে পাঁচ-ছয় লাখ ডোজ টিকা আমরা নিয়ে আসতে পারব যথাযথ তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেই।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. শামসুল হক বলেন, ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার বাইরে এখন পর্যন্ত অন্য কোনো টিকার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। মন্ত্রণালয় বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে কিছু আবেদন হলেও হতে পারে।’
তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পরামর্শ : এমন পরিস্থিতির মধ্যেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজের পর দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেওয়ার মধ্যবর্তী সময় দুই মাস থেকে বাড়িয়ে তিন মাস করার পরামর্শ দিচ্ছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। এরই মধ্যে এমন পরামর্শ সরকারকে দিয়েছে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোশতাক রাজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি। কমিটির সদস্যরা যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের একটি তথ্য তুলে ধরে পরামর্শভিত্তিক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দ্বিতীয় ডোজ ৯০ দিন পর দেওয়া হলে কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে ৭৬ শতাংশ সুরক্ষা দেয়। অর্থাৎ প্রথম ডোজ থেকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সময় বাড়ালে কার্যকারিতা বাড়ে বলেও ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। গত ২৮ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। ডা. শামসুল হক বলেন, দুই মাসের পরিবর্তে তিন মাস পরে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার একটি পরামর্শ এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে, তবে বিষয়টি এখনো কোনো সিদ্ধান্তের পর্যায়ে যায়নি।
নিবন্ধন করেও প্রথম ডোজ দিতে পারছেন না ১০ লাখের বেশি মানুষ : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গতকাল পর্যন্ত টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন ৬৮ লাখের বেশি মানুষ। ফলে সামনের দিনগুলো বাদ রেখেই গতকাল পর্যন্ত নিবন্ধন করা ১০ লাখের বেশি মানুষ আপাতত প্রথম ডোজের টিকা পাচ্ছেন না।