ভেদাভেদ ভুলে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের মঙ্গলে কাজ করতে দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভারত এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ দেশ। একটি স্থিতিশীল এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে হলে ভারতকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে এলে আমাদের জনগণের উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী। এ অঞ্চলে যে সম্পদ রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলটাকে আমরা ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত করতে সক্ষম হবো।’
শুক্রবার (২৬ মার্চ) ঢাকায় জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
‘স্বাধীনতার ৫০ বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা’—এই থিমে শুক্রবারের আয়োজনে প্রধান অতিথি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ অংশ নেন। সম্মানিত বিশেষ অতিথি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে ১০ দিনের এই কর্মসূচি শুরু হয় গত ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। শুক্রবার স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির দিনে তা শেষ হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুপ্রতিম ভারতের অবদানের কথা স্মরণ করেন। স্মরণ করেন পিতা মুজিবকে নির্মমভাবে হত্যার পর তাঁকে ভারত সরকারের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টিও।
তিনি বলেন, ‘আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ৫০ বছর আগে এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি জান্তাদের হাতে বন্দি হওয়ার আগ মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।’
বঙ্গবন্ধুকে ভারত সরকার গান্ধি শান্তি পদক দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভারত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এই শুভ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মর্যাদাশীল ‘গান্ধি শান্তি পুরস্কার-২০২০’-এ ভূষিত করার জন্য। এই পুরস্কারে ভূষিত করার মাধ্যমে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একজন যোগ্য নেতা এবং গান্ধিজির প্রকৃত অনুসারীকেই সম্মানিত করলো।’
বাংলাদেশের সুখে-দুঃখে ভারত পাশে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভারত সরকার বাংলাদেশের জনগণের জন্য ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স উপহার দিচ্ছে। আমাদের ১২ লাখ করোনার টিকা উপহার দিয়েছেন। আরও টিকা উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি, তার সরকার এবং ভারতের জনগণের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
ভারতের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘ভারত শুধু আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রই নয়, ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যগত এবং ভৌগোলিক সেতুবন্ধন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে ভারতের সরকার এবং সে দেশের জনগণ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারের মুখে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করেছিল। বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানের মধ্য দিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জনগণের যে আত্মত্যাগ, সাহায্য-সহযোগিতা, তা কখনও ভুলবার নয়। আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে সে অবদানের কথা স্মরণ করি।’
অন্য দেশের ক্ষেত্রে যা-ই হোক না কেন, বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণ এক ও অভিন্ন থাকে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় উল্লেখ করেন।
জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড এবং তারপরে ভারতে আশ্রয় পাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আমার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমরা দুই বোন জার্মানিতে থাকায় বেঁচে যাই। আমাদের দেশে ফিরতে বাধা দিলে আমরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ি। আমার পরিবার এবং ছোট বোন শেখ রেহানাকে ভারত সরকার আশ্রয় দেয়।’
এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। ওই সরকার আমাদের দেশে আসতে দেয়নি। এমনকি আমার বোন রেহানার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেই পাসপোর্টও তারা দেয়নি।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিচ্যুতি ঘটিয়েছিল।’
বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রযাত্রার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নানা প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে আমরা বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাচ্ছি। বিগত ১২ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। আমরা ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছি।’
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশ সরকার প্রধান বলেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে বর্তমানে আমাদের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রী মোদিজির ‘প্রতিবেশী সর্বাগ্রে’ নীতির প্রশংসা করি। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের টিকা পাঠানোর মাধ্যমে মোদিজির এই নীতিরই প্রতিফলন ঘটেছে।’
তিনি বলেন, ‘ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোরর সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি ফেনী নদীর ওপর মৈত্রী সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে। এই রাজ্যগুলো এখন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক সহযোগিতায় বিশ্বাসী ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি স্বপ্ন দেখতেন অর্থনৈতিক মুক্তির। এজন্য পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা এবং সমতার ভিত্তিতে সহযোগিতার ওপর তিনি জোর দিতেন।’
ভারত এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ দেশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটি স্থিতিশীল এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে হলে ভারতকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা যদি পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসি, তাহলে আমাদের জনগণের উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশের জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এই শুভ মুহূর্তে আসুন প্রতিজ্ঞা করি, সব ভেদাভেদ ভুলে আমরা আমাদের জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করবো।