যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে কম্পিউটার বলতে এসি রুমে আবদ্ধ এক সম্ভ্রান্ত যন্ত্র। প্রায় দু শ’ বছর ব্রিটিশ আর ২৪ বছর পাকিস্তানিদের নিষ্পেষণের পর বিপর্যস্ত অর্থনীতি নিয়েই বাংলাদেশের হাল ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার প্রথম বছরে আইসিটিতে বাংলাদেশের অর্জন বলতে ছিল, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কৃত্রিম ভূ উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন এবং আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের সদস্য হওয়া। সেটাই ছিল শুরু। তবে এই স্বপ্ন সহজে পূরণ হয়নি। ৭৫ পরবর্তী সময়ে উল্টো পথে রওনা দেয়া বাংলাদেশে পরবর্তীতে আসা ক্ষমতাসীনরা দেশের ভালো-মন্দটাও বুঝে উঠতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বক্তব্যে বলেন, ‘সাবমেরিন ক্যাবলের সংযোগটা যখন আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আসে বাংলাদেশ তখন সাবমেরিন ক্যাবলের বিনা পয়সায় সংযোগের সুযোগ পেয়েছিল। তখন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন যে এটা সংযুক্ত করা যাবেনা। এটা করলে নাকি সকল তথ্য প্রকাশ হয়ে যাবে।’
৯০এর দশকে মোবাইলফোন, ধীরে ধীরে বিদেশী স্যাটেলাইট ব্যবহার করে টেলিভিশন সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির উত্তরণ, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহারসহ নানাভাবে আইসিটি খাতে এগিয়েছে দেশ। এরপর থেকেই প্রযুক্তি দুনিয়ায় শুরু হয় বাংলাদেশের পথ চলা। সেই প্রযুক্তির পথ চলা ডিজিটাল বিপ্লবে রূপান্তর হয় ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণায়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘২০২১ সালের মধ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে।’
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আমাদের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ যে কাজে, যেভাবে মিডিয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে সেখানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ হয়তো ভিন্নমাত্রার, ভিন্ন কাজে, ভিন্ন আঙ্গিকের জন্য ব্যবহৃত হবে।’
শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আইডিয়া কার্যত লুফে নিয়েছিলো বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। একে একে পূরণ হতে থাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মূল চার স্তম্ভ-মানব সম্পদ উন্নয়ন, জনগণের অংশগ্রহণ, সরকারি সেবার ডিজিটালাইজেশন এবং তথ্য প্রযুক্তি খাত দিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেটের দাম ছিল ৭৮ হাজার টাকা, যা এখন ৩০০ টাকার নিচে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন ১০ কোটির বেশি। অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল সংযোগের মাধ্যমে ৩ হাজার ৮শ’ ইউনিয়নে ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে এবং ১৮ হাজার ৫শ’টি সরকারি অফিসকে একই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নে সরকারি দপ্তরের এ পর্যন্ত ৬৫৭ ই-সেবা এবং ৮৬ দশমিক ৪৪ লাখেরও বেশি বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট যুক্ত করা হয়েছে। এ বাতায়নে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখেরও বেশি জনগণ তথ্য ও সেবা গ্রহণ করছে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে লিখিতভাবে আইডিয়া ধার করে মালদ্বীপ ডিজিটাল হওয়ার ঘোষণা দেয়। বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে সম্প্রতি পাকিস্তানও একই পথে হাঁটা শুরু করেছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘একটি শক্ত ভিত্তির উপরে ডিজিটাল বাংলাদেশ দাঁড়িয়েছে এবং আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল সেটি অর্জিত হয়েছে। এমনকি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি আমাদের প্রাপ্তি হয়েছে।’
প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতির নানা সূচকেও বিশ্বের বহু দেশকে এখন পিছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, এক বছরে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশেই এখন তৈরি হচ্ছে নামি দামি ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন। কালিয়াকৈর বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে প্রস্তুত হচ্ছে দেশের প্রথম অটোমোবাইল কারখানা। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৭ম বৃহত্তম ডাটা সেন্টারের মালিক।
ই-গভর্ন্যান্সের জাতীয় ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১১৫ নম্বরে, আগামী ৫ বছরের মধ্যে আরও ৫০ ধাপ এগিয়ে আসার লক্ষ্য রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা যাতে অফিসের বাইরে থেকেও দাপ্তরিক কার্যক্রম সুচারুভাবে সারতে পারেন, সে জন্য তাদের ২৫ হাজার ট্যাব দেয়া হয়েছে।
সরকারের বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও সেবা ডিজিটালাইজেশনের আওতায় ৬০০ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে এসব মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করছে। এ ছাড়া ২০০ বছরেরও বেশিদিন ধরে প্রচলিত বিচারিক কার্যক্রমকে ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সাইবার হয়রানি রোধে একটি সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এই কর্মসূচির আওতায় একটি হেল্পলাইনও চালু করা হয়েছে।
দেশে মোবাইল ব্যাংকিং এর বিকাশ ঘটেছে। চালু হয়েছে স্টার্টআপ সংস্কৃতি। পাশাপাশি বেড়েছে অনলাইনে কেনাকাটাও। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফলে দ্রুত দেশের যেকোনো প্রান্তে আর্থিক লেনদেন করা যাচ্ছে। স্টার্টআপ এর কারনে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। শতাধিক স্টার্টআপকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেইজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেইজ চালাচ্ছেন নারীরা।
কৃষিতে প্রযুক্তি বদলে দিয়েছে কৃষকের জীবন। ‘কৃষি বাতায়ন’ এবং ‘কৃষক বন্ধু কলসেন্টার’ সরকারের বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক সেবাগুলোর জন্য কলসেন্টার হিসেবে কাজ করছে।
কোভিড-১৯ এ যখন সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থা স্থবির। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ডিজিটাল উদ্যোগ মানুষকে দেখিয়েছে নতুন পথ, যুগিয়েছে প্রেরণা। সরকারি অফিসগুলোতে চালুকৃত ই-নথি ব্যবস্থা সেবা কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা এবং কারিগরি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস হয়েছে অনলাইনে।
এ পর্যন্ত মোট ৫ হাজার ৬৬৮টি অনলাইন ক্লাস প্রচারিত হয়েছে এবং আপদকালীন সময়ে শিক্ষা কার্যক্রমে ৫ হাজার ৮৬ জনের বেশি শিক্ষক যুক্ত রয়েছেন। নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ডিজিটাল মাধ্যমে কার্যকরী ও সহজ উপায়ে চলমান রাখতে ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’ প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে। লাইভ ক্লাস বা ট্রেনিং পরিচালনা, এডুকেশনাল কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট, মূল্যায়ন বা অ্যাসেসমেন্ট টুলস, মনিটরিং এবং সমন্বয় করার প্রযুক্তি যুক্ত রয়েছে।
হাই-টেক শিল্পের বিকাশ ও কর্মসংস্থানের জন্য সরকার ৩৯টি হাই-টেক পার্ক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপন করছে। এগুলোর কাজ শেষ হলে ৩ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এগুলোর জন্য ২০২৫ সালের মধ্যে ২,৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। চালু হওয়া ৫টি পার্কে ১২০টি প্রতিষ্ঠান ৩২৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে, আইটিতে দক্ষ ১৩ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রতিযোগিতা মোকাবেলায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইওটি, রোবোটিক্স, সাইবার সিকিউরিটির উচ্চপ্রযুক্তির ৩১টি বিশেষায়িত ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর স্থাপন করা হবে। প্রতিটি জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।
তথ্য ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘যে জায়গাগুলোতে সমন্বয়ের দরকার ছিল সেটা হয়নি। আজকে যদি কেউ চায় যে, কোন হাসপাতালে কয়টা সিট খালি রয়েছে তা অনলাইনে দেখবে, সে তথ্য পাওয়ার কোন উপায় নেই। এই তথ্যগুলো সরকারিভাবে সংগ্রহও করা হয় কিন্তু তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য যে ব্যবস্থা করার দরকার ছিল সেটা আমরা করতে ব্যর্থ হচ্ছি।’
২০১৮ সালের ১১ই মে, প্রযুক্তি দুনিয়ায় আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। মহাকাশে ঠাঁই করে নেয় বাংলাদেশের মালিকানাধীন বঙ্গবন্ধু সেটেলাইট-১। তবে এখানেই থেমে থাকা নয়। বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানী লিমিটেড, বিসিএসসিএল এর চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল যে এই জাতি যেন সব সেক্টরে স্বনির্ভর হতে পারে।’