বিজয় সরণী সিগন্যালে রোববার সকালে যানজটে আটকে শখানেক যানবাহন। মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ীগামী শিকড় পরিবহনের এক বাসের চালক সিটে বসে সিগারেট ফুঁকছিলেন। অর্ধেক টানার পর বাকিটুকু দিলেন সহকারীকে। পাদানিতে দাঁড়িয়ে বাকি অর্ধেক সিগারেট শেষ করলেন চালকের ওই সহকারী। দুই দিক থেকে আসা সিগারেটের ধোঁয়া থেকে রক্ষা পেতে সামনের দিকের আসনে বসা এক নারী নাকে কাপড় চেপে বসেছিলেন।
এই বাসের চালক-সহকারীর মতো এখনো অনেকে গণপরিবহনে কিংবা জনপরিসরে (পাবলিক প্লেস) দেদারসে ধূমপান করেন। অথচ ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী জনপরিসর ও গণপরিবহনে ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
গণপরিবহনে ধূমপানের অন্যতম ভুক্তভোগী নারী এবং শিশুরা। নিত্যদিনের ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। অনেকে মাঝেসাঝে বিরক্ত হয়ে চালক-সহকারীদের ধূমপানের প্রতিবাদ করেন। তবে এতে প্রতিকারতো মেলেই না, উল্টো হেনস্তার শিকার হতে হয়।
শিকড় বাসের চালকের সহকারী নাসির জানান, রাস্তায় ধূমপান করলে জরিমানা হতে পারে তিনি জানেন। তবে কখনো দিতে হয়নি। আর যাত্রীদের বিরক্তির বিষয়টি কখনো আমলেই নেননি।
সর্বশেষ গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে গণপরিবহনে কিংবা জনপরিসরে ধূমপান নিষিদ্ধ হওয়ার পরও প্রতিবছর গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় প্রায় আড়াই কোটি মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন।
বর্তমান আইন অনুযায়ী, জনপরিসর ও গণপরিবহনে’ ধূমপানের জরিমানা ৩০০ টাকা। আর এসব স্থান ধূমপানমুক্ত রাখতে না পারলে মালিক বা ব্যবস্থাপকদের জরিমানা হবে ৫০০ টাকা।
কিন্তু গণপরিবহনে চলাচলকারী যাত্রীরা বলেন, আইন কেবল কাগুজে ব্যাপার এক্ষেত্রে। প্রয়োগ হয় না বললেই চলে। যার ফলে ধূমপান না করেও অনেক নারী-শিশু ফুসফুসজনিত নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
উম্মে সালমা চাকরি করেন রাজধানীর শ্যামলীর একটি কিন্ডারগার্টেনে। তাকে অফিস করতে যেতে হয় বাসে চড়ে। করোনার সময় মাঝে বাসায় থাকলেও এখন প্রায়ই তাঁকে অফিসে যেতে হয়। তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ পাবলিক বাসে নারীদের বসার সিট সামনের দিকে। সেখানে বসাই দায়। কিছু কিছু বাসের চালক ও তার সহযোগীর সিগারেটের ধোঁয়ায় অত্যাচার তাকে প্রায়ই সহ্য করতে হয়।’
সালমা বলেন, ‘শহরে এমনিতেই মেট্রোরেলসহ নানান নির্মাণকাজ ও খোঁড়াখুঁড়ির জন্য ধুলোর বিড়ম্বনা। এরপর পাবলিক বাসে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়া। সবমিলিয়ে রাস্তায় চলাচল এখন বড় যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠছে।’
গ্যাটসের সর্বশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের পর গণপরিবহনে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানোর জন্য কিছুটা তোড়জোড় শুরু করেছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে কদিন না যেতেই সেটির গতি মন্থর হয়ে যায়।
পরোক্ষ ধূমপান স্বাস্থ্যের প্রত্যক্ষ ধূমপানের মতোই ক্ষতিকর। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মো. হাফিজ সরদার বলেন, ‘ধূমপান না করা মানে আপনি ধূমপানঘটিত রোগ থেকে রেহাই পেয়ে গেলেন, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। বরং যারা ধূমপান করছে তাদের ভেতরে ধোঁয়াটা ফিল্টারের মাধ্যমে কিছুটা পরিশোধিত হচ্ছে। কিন্তু যারা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন তাদের ভেতরে সিগারেটের ধোঁয়াটা কোনো রকমের ফিল্টার ছাড়াই সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করে।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘পরোক্ষ ধূমপানের শিকার তাদের ফুসফুসে ক্যানসার, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্ককাইটিস, পাকস্থলীতে ক্যানসারসহ নানা ব্যাধী হয়।
প্রায়ই এমন রোগীদের চিকিৎসা করতে হয় যারা ধূমপায়ী নয়, কিন্তু এর ক্ষতির সমান ভুক্তভোগী।’
হাফিজ সরদারের মতে, ‘অনেক গণপরিবহনের পরোক্ষ ধূমপানের কারণে শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম থাকে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বাল্যকাল থেকে তারা ক্রনিক ডিজিজ (দীর্ঘস্থায়ী রোগে) আক্রান্ত হয়ে যায়।’
গণপরিবহনে ধূমপানের বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর উপপরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) আব্দুর রাজ্জাক জানান, তাঁরা নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, ‘নগর পর্যায়ে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং জেলা পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।’
আব্দুর রাজ্জাক আরো বলেন, ‘এছাড়া প্রচার-প্রচারণা, অনলাইন ক্যাম্পেইন, চালক-মালিকদের মাঝে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।’ চালকের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপানের বিষয়ে তাদের সতর্ক করা হয় বলে জানালেন তিনি।