হয়ে গেছে শুরু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ধুন্ধুমার আসর। বিশ্ববাসী মেতে উঠেছে ক্রিকেটের এই ক্ষুদ্র সংস্করণের উত্তেজনায়। চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে মেতেছে ক্রিকেটের বিশ্ব আসর। টানা নবমবারের মতো বাংলাদেশও আছে এই ক্রিকেট মহাযজ্ঞে।
তবে আগের আসরগুলোতে তেমন কোনো দাগ কাটতে পারেনি টাইগাররা। ২০ দলের টুর্নামেন্ট বলে ভালো কিছু করার সুযোগ আছে বাংলাদেশের, এমন ধারণাই ছিল সবার। এবার সেই না পারার গভীর ক্ষতে পারার সুবাতাস বইয়ে দেওয়ার প্রত্যাশা ছিল নাজমুল হোসেন শান্তদের কাছে। কিন্তু প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির মিলন ঘটানো যাচ্ছে না। ছিল এই কারণে বলছি যে, সম্প্রতি টি-টোয়েন্টির চার-ছক্কার ঝড়ে দিশেহারা বাংলাদেশ।
সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ইতিহাস মোটেই ভালো নয়। ক্রিকেটের এই ফরমেটে বড়ই নড়বড়ে টাইগাররা। বলার মতো সাফল্য নেই। অবশ্য ক্রিকেটের নতুন এই সংস্করণে যাত্রা শুরু হয়েছিলো জয় দিয়েই। সময়ের সাথে সাথে সেই ধারা আর ধরে রাখা যায়নি। জয়ের পরিবর্তে পরাজয়ের গ্লানিই সঙ্গী হয়েছে নিরন্তর। তবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে তাদেকে হারিয়ে নিজেদের উন্নতির জানান দিয়েছিল টাইগাররা।
তিন ম্যাচের সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি জিতে কিউইদের রীতিমতো ঘাবড়ে দিয়েছিল নাজমুল হোসেন শান্তর দল। বৃষ্টিতে দ্বিতীয় ম্যাচটি পন্ড হয়ে যায়। তৃতীয় ম্যাচে পরাজিত হয় টিম টাইগার্স। তাতে ১-১ এ সিরিজ ড্র করে দেশে ফেরো বাংলাদেশ। এরপর থেকে আত্মবিশ্বাস কিংবা টি-টোয়েন্টিতে উন্নতির গ্রাফটা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সুখের আনন্দ বেশি সময় থাকেনা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তো এই আনন্দ আরো কম স্থায়ী হয়।
চলতি বছরের মার্চে শ্রীলংকার কাছে আবার আত্মসমর্পণ শান্তদের। তিন ম্যাচের সিরিজ ২-১ এ জিতে নেয় লংকান সিংহরা। সিলেটে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে জয়ের খুব কাছে গিয়েও ৩ রানে হার। দ্বিতীয় ম্যাচে ৮ উইকেটে জিতে বীরদর্পে ম্যাচে ফেরা। কিন্তু তৃতীয় ও শেষ টি-টোয়েন্টিতে শ্রীলঙ্কার কাছে আবারও আত্মসমর্পণ বাংলাদেশের। এবার পরাজয় ২৮ রানের। বাংলাদেশ যেনো যতটুকু এগিয়ে যায় পরের ম্যাচে ঠিক ততটুকুই পিছিয়ে আসে। কোনো ভুল থেকেই শিক্ষা নেয় না।
আর মে মাসে তো টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের কংকালসার দেহটাই বেরিয়ে আসে। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ সফরে আসে জিম্বাবুয়ে। তবে এক সময়ের প্রবল প্রতাপশালী অবস্থা তাদের আর নেই। তারাও এখন কেবল নিজেদের ছায়া হয়ে আছে। সেই জিম্বাবুয়েকে বাংলাদেশ উড়িয়েই দেবে এমন ভাবনাটা মোটেই অমূলক নয়। দুর্বল জিম্বাবুয়েকে প্রথম চার ম্যাচে হারালেও পঞ্চম ও শেষ ম্যাচে হেরে যায়।
অবশ্য জিম্বাবুয়ে যে যেকোনো সময়ে বাংলাদেশকে হারিয়ে দিতে পারে, তৃতীয় ম্যাচ থেকেই তা বুঝা যাচ্ছিল। প্রথম দুই ম্যাচ হারের পর তারা উন্নতি করছিলো, প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিলো বাংলাদেশের বিপক্ষে। এবং শেষ ম্যাচে এসে মরণকামড় দিয়ে বসে। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে ৮ উইকেটে হারিয়ে দেয় তারা বাংলাদেশকে, তাও আবার ৯ বল হাতে রেখে।
বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য দুর্বল শক্তির জিম্বাবুয়েকে এনেও লাভ হয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের। অবশ্য বিশ্বকাপ প্রস্তুতির জন্য জিম্বাবুয়ে কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ভালো কোনো পছন্দের দল নয়, হতে পারে না। কিন্তু ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম এই ফরমেটে মনোবল একেবারে তলানিতে থাকা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে দল দুটি প্রেরণার মঞ্চ হতে পারতো। কিন্তু ক্রিকেটাররা সেই সুযোগ নিতে ব্যর্থ। তাতে হারের পর হার। পরাজয়ের বেদনায় মলিন বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্র সিরিজ তো বাংলাদেশের ব্যর্থতার কাঁচা ঘায়ে লবণ লাগিয়ে দেওয়ার মতোই। বিশ্ব ক্রিকেটে একটি নাম-গোত্রহীন দলের কাছে ২-১-এ সিরিজ হার, টাইগারদের সামর্থ এবং পারদর্শিতা নিয়ে যেনো নিদারুণ এক ব্যঙ্গ। অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যাটিং ব্যর্থতায় ভুগছে বাংলাদেশ দলের টপঅর্ডার। ব্যাটে রান খরা। সেটা কাটানোর চেষ্টার কোনো কমতি নেই। কিন্তু সমাধানের পথ জানা নেই। সব পরামর্শ থেমে যায় মাঠে নেমে। ব্যাট হাতে ২২ গজে নেমেই যেনো সবকিছু ভুলে যান টাইগার ক্রিকেটাররা।
মেরিকা তো এক নতুন জায়গা। তাই আমেরিকার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে টুর্নামেন্টে শুরুর আগেই সেদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করে বিসিবি। শুধু অনুশীলন করলেই তো হবে না খেলতেও হবে। তাতেই বুঝা যাবে দলের উন্নতি। ক্রিকেটারদের ব্যাডপ্যাচ কাটলো কিনা জানা যাবে সেটাও। যেই ভাবনা সেই কাজ।
বিশ্বক্রিকেটে একেবারে নবিস এক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। সবকিছু ভাড়া নিয়েই চলছে দলটি। মানে অভিবাসী ক্রিকেটারদের নিয়ে গঠন করা এক দল যুক্তরাষ্ট্র। বাস্কেটবল, বেসবলের দেশে ক্রিকেটসংস্কৃতি খুব একটা পাত্তাই পায়নি। শুধুমাত্র বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক হওয়ার সুবাদে তারা এবারই প্রথম অংশ নিচ্ছে বিশ্বকাপে। এমন একটি দেশের ইচ্ছেই থাকবে, চমক দিয়ে এবং সবাইকে চমকে দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার। ছিলোও। সেটা করেও দেখিয়েছে তারা।
টেক্সাসের প্রেইরি ভিউ স্পোর্টস কমপ্লেক্সে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশকে ৫ উইকেটে হারিয়ে রূপকথার এক গল্প রচনা করে যুক্তরাষ্ট্র। টপঅর্ডার ব্যর্থতা অব্যাহত থাকে এই ম্যাচেও। দ্বিতীয় ম্যাচেও রান খরা কাটেনি টপঅর্ডারের। তাতে ৬ রানে পরাজয় বাংলাদেশের। যুক্তরাষ্ট্রের মতো নবীস একটি দেশের কাছে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হারায়, চারদিক থেকে ‘জাত গেলো জাত গেলো’ বলে কথা উঠতে থাকে। পরাজয়ে ক্রমে মূহ্যমান হতে থাকে টাইগাররা।
দেশ ছাড়ারা আগে বিশ্বকাপে কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলতে পারেনি হাথুরুসিংহের দল। ভালো খেলার কথা জানিয়েছিল। টুর্নামেন্টের ২০টি দলই ভালো ফলাফলের আশা নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছে। সবাই ভালোই করতে চায়, খারাপ করার জন্য কেউ কোথাও খেলতে যায় না। বাংলাদেশও যায়নি। তবে যে ব্যাডপ্যাচ চলছে, তা কাটিয়ে উঠুক বাংলাদেশ।
ক্রিকেট বিষয়টা এমনই নিজেদের দিনে যেকোনো শক্তিকে হারানো যায়। অবশ্য টি-টোয়েন্টিতে খুবই নাজুক অবস্থা শান্ত-সাকিবদের। ২০০৬ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত খেলা ১৬৯ ম্যাচে জিতেছে মাত্র ৬৫টি। হারের সেঞ্চুরি পুরণ করেছে সম্প্রতি। আর চারটি ম্যাচে কোনো রেজাল্ট হয়নি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সাফল্যও আশাপ্রদ নয়। এ পর্যন্ত ৩৮ ম্যাচে জয় পেয়েছে মাত্র ৯টিতে। শতকরা হিসেবে সাফল্য ২৩.৬৮%। হেরেছে ২৮টি ম্যাচে, একটি ম্যাচে কোনো ফল হয়নি।
ধারণা করছি, টাইগাররা ফিরবে জয়ের ধারায়। চলতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নাজমুল হোসেন শান্তদের প্রথম প্রতিপক্ষ শ্রীলংকা। সেই ফেরাটা লংকানদের বিপক্ষে হলেই বরং ভালো। তাতে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন ক্রিকেটাররা। আর প্রাণ ফিরে পাবেন বাংলাদেশের দর্শক-সমর্থকরা।
প্রথম ম্যাচে জয়ের প্রভাবটা ছড়িয়ে পড়বে পরের ম্যাচগুলোতেই। একটা জয়ই হতাশ-মলিন-ভঙ্গুর বাংলাদেশের পালে লাগাতে পারে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বাতাস। রেকর্ড ভাঙা আর নতুন রেকর্ড গড়ার টুর্নামেন্টে লাল-সবুজের দলও এগিয়ে যায় সাফল্যের সোপান ধরে অনেকদূর। ক্রিকেটাররা যেন নিজেদের খুঁজে পান প্রথম ম্যাচেই।