গত বছর নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনার পরও টনক নড়েনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) ও সিটি করপোরেশনের (চসিক)। খোলা নালায় বেষ্টনী দেওয়ার ব্যাপারেও কোনো অগ্রগতি নেই। শনিবার চান্দগাঁও থানার পাঠানিয়া গোদা এলাকায় মায়ের সঙ্গে হেঁটে যাওয়ার সময় এক শিশু নালায় পড়ে যায়। দ্রুত উদ্ধার করায় প্রাণে বেঁচে যায় শিশুটি।
নালায় পড়ে যাওয়ার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। একইভাবে রোববার সকালে নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার স্বাধীনতা কমপ্লেক্সের সামনে খোলা নালায় পড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন কাজল মিয়া। তার বাড়ি চকরিয়া উপজেলায়। স্থানীয় ও প্রক্ষদর্শীরা খবর দিলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে এক ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করেন। এভাবে খোলা নালায় পড়ে প্রায়ই ঘটছে হতাহতের ঘটনা।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, চান্দগাঁও থানার পাঠানিয়া গোদা এলাকায় বোরকা পরিহিতা দুই নারী এক শিশুকে নিয়ে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে এক নারীর হাত ধরা অবস্থায় শিশুটি সাফা মারওয়া ইলেকট্রনিক্স নামক দোকানের সামনের ফুটপাতে থাকা গর্তে পড়ে যায়। তবে দুই নারী দ্রুত শিশুটিকে টেনে তুলতে সক্ষম হন। রোববার বহদ্দারহাট এলাকার নালায় পড়া মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে উদ্ধারের পর কালুরঘাট ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার বাহার উদ্দিন বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন লোকটি খোলা নালা পেয়ে লাফিয়ে পড়েন। নালা গভীর হওয়ায় উপরে উঠে আসতে পারছিলেন না। পরে খবর পেয়ে আমরা তাকে উদ্ধার করি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নগরজুড়ে চলছে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় খাল খনন কার্যক্রম। একইভাবে নগরীর লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত চলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ। এসব উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করছে চউক। কিন্তু কাজ করা হলেও দেখা গেছে, নগরীর অধিকাংশ খালের দুই পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। কোথাও কোথাও নালার ওপর নেই স্ল্যাব। এ কারণে খাল ও নালাগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।
গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে অরক্ষিত নালায় পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন রাতে মামা জাকির হোসেনের সঙ্গে আগ্রাবাদে চশমা কিনতে গিয়েছিলেন সাদিয়া। ফুটপাতের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পা পিছলে নালায় পড়ে যান তিনি। তাকে বাঁচাতে মামা জাকির হোসেন লাফিয়ে পড়েন। তবে স্রোতের কারণে তিনি ভাগ্নিকে খুঁজে পাননি। পাঁচ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলের ৩০ ফুট দূরে ৭০ ফুট গভীর থেকে নালায় জমে থাকা আবর্জনা সরিয়ে সাদিয়াকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।
এর আগে ২৫ আগস্ট দুপুরে মুরাদপুর মোড়ে পা পিছলে নালায় পড়ে যান সালেহ আহমদ নামে এক সবজি ব্যবসায়ী। ছাতা হাতে রাস্তা পারের সময় নালায় পড়ে যাওয়ার দৃশ্য সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে। সেকেন্ডের মধ্যে কিভাবে একটি লোক পানিতে তলিয়ে গেল সেই ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
এর আগে ৩০ জুন নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেট মেয়র গলি দিয়ে যাওয়ার সময় একটি সিএনজি অটোরিকশা খালে পড়ে যায়। সে াতে ভেসে যান চালক সুলতান ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। গ্রাম থেকে শহরে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন ওই মহিলা।
৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে পানির স্রোতে চশমা খালে তলিয়ে যায় ১০ বছরের শিশু কামাল উদ্দিন। উন্মুক্ত খালে খেলনাসদৃশ বস্তু দেখতে পেয়ে দুই বন্ধু ওই খালে নামে। এক বন্ধু পা পিছলে পড়ে গেলে তাকে উদ্ধার করতে যায় কামাল। সাঁতার জানায় ওই বন্ধু উদ্ধার হলেও কামাল তলিয়ে যায়। কামালের দিনমজুর বাবা একরাত একাই খালের এখানে-ওখানে খোঁজেন সন্তানকে। কিন্তু খোঁজ পাননি। পরে ফায়ার সার্ভিসও শিশুটিকে উদ্ধারে ব্যর্থ হয়। ঘটনার তিন দিন পর ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে মোহাম্মদপুর এলাকার মির্জা খালে শিশুটির লাশ ভেসে ওঠে। স্থানীয় লোকজন দেখতে পেয়ে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলে সেখান থেকে লোকজন গিয়ে লাশ উদ্ধার করেন।
এসব ঘটনার পর নালাগুলোতে স্লাব বসানো বা অরক্ষিত নালায় নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়ার দাবি ওঠে। কয়েকটি স্থানে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হলেও অনেক নালা এখনো খোলা অবস্থায় রয়ে গেছে। একের পর এক দুর্ঘটনার জন্য চউক ও চসিক একে অপরকে দায়ী করলেও কোনো পক্ষই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। তাই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে।