বাজার একচেটিয়াভাবে জোটবদ্ধ ব্যক্তি-গোষ্ঠীর কাছে চলে যাওয়ায় নিত্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণ বলে মনে করছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আইন করলেও এখন পর্যন্ত সে আইনের বিধি না করায় আইনের প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। এটি দুর্ভাগ্যজনক। আর এর সুযোগ নিচ্ছে জোটবদ্ধ ব্যক্তি-গোষ্ঠী।
সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে করা রিট আবেদনের শুনানিতে এমন পর্যবেক্ষণ এসেছে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মো. মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে।
সোমবার দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে প্রথমেই এ রিটের বিরোধিতা করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল প্রতিকার চাকমা বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। ইতিমধ্যে সয়াবিন তেলসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার দর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সরকার বাজার তদারকিতে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এ রিটে রুল জারি করা ঠিক হবে না।
তখন রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, প্রতিযোগিতাবিরোধী জোটক কিভাবে নিরূপণ করছেন? ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন হয়েছে। এখন পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন নেই। প্রতিযোগিতা বিরোধী চুক্তি, কর্তৃত্ব বন্ধ করতে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল প্রতিকার চাকমা জবাবে বলেন, এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আদালত প্রতিযোগিতা আইনের তৃতীয় অধ্যায়ের ১৫ ধারা উল্লেখ করে তখন বলেন, এ আইনে মনোপলি (একচেটিয়া) ব্যবসা বন্ধের কথা বলা আছে। সরকার বিধি-নীতিমালা করছে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ কারণে আইনের প্রয়োগ নাই। এরকমটা সব সময় হয়ে আসছে। আপনারা যদি কঠোর হতেন তবে বাজার লাগাম ছাড়া হতো না। আগে থেকে সচেষ্ট থাকলে জনসাধারণের ভোগান্তি হত না। একচেটিয়া ব্যবসা একটা গ্রুপের কাছে চলে যাওয়ায় এমনটা হচ্ছে। অথচ এটি বন্ধ করতে রেগুলেটরি বডি (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) গঠনের কথা আইনে বলা আছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকলে আমাদের কাছে (আদালতে) আসতে হত না। আমরা চাচ্ছি, এগুলো হোক। আমাদের সামনে আইন বাস্তবায়নের দৃশ্যমান কোনো উদাহরণ নাই।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল প্রতিকার চাকমা আবার বলেন, সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে, সক্রিয় আছে। বাজার এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
আদালত তখন এ আইন কর্মকর্তার কাছে প্রশ্ন রাখেন, কবে থেকে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে? সরকারের মেশিনারিজগুলো (আইন, বিধি, নীতিমালা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, তদারক সংস্থা) সক্রিয় থাকলে মজুদকারীরা সাহস পেত না। আইন, সংগঠন সবকিছু আছে, কিন্তু প্রয়োগ নাই। মেশিনারিজগুলো সক্রিয় করলে এরা সাহস পাবে পাবে না। এর জন্য কার্যনকর উদ্যোগ প্রয়োজন। সেটি নাই। আমরা চাই সরকারের মেশিনারিজগুলো ৩৬৫ দিনই সতর্ক-সোচ্চার থাকুক। এটা (বাজার তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ) একদিনের কাজ না। যতটুকু হয়েছে সেটি প্রসংশনীয়।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের কাজ চলছে। একচেটিয়াভাবে কেউ যাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে তার জন্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার টাস্কফোর্স গঠনে হাত দিয়েছে। বাজার দর এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। বাজারে বাজারে গিয়ে গিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ফলে এরকম পরিস্থিতিতে এই রিটে রুল দেওয়া ঠিক হবে না।
আদালত বলেন, সরকার খাদ্য পণ্যের বাজার দর ঠিক করে দিচ্ছে। আর একটা গ্রুপ জোটবদ্ধ হয়ে সেসব পণ্য মজুদ করছে। পরে দাম বাড়িয়ে তা বাজারে ছাড়ছে। জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে যচ্ছে।
আদালত আরো বলেন, যারা দুষ্কৃতিকারী তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। সারা বছর বাজার তদারকি করতে হবে। রোজা আসলে তদারকি হবে, এমনটা হলে হবে না। এটা প্রতিদিনের কাজ, প্রতিদিন করতে হবে। আইন লঙ্ঘন করা চলবে না।
পরে রিটকারী আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, যেকোনো সময় যেকোনো খাদ্য পণ্যে দাম বাড়তে পারে। কিন্তু আপনাকে নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্যের বিষয়ে আসা উচিত। আপনার রিট আবেদনের আরজি যথাযথ হয়নি।
এরপর আদালত রিট আবেদনটি সংশোধন করে নিয়ে আসতে বলে এর শুনানি মঙ্গলবার পর্যেন্ত মুলতবি রাখেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সয়াবিন তেলের দাম বিাড়িয়েছে, একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত এমন খবর নজরে এনে স্বপ্রণোদিত আদেশ চান সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী। গত ৩ মার্চ তারা বিষয়টি আদালতের নজরে আনলে আদালত তাদের যথাযথ আবেদন নিয়ে আসতে বলেন, পরে তরা হাইকোর্টে রিট করেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন রিটকারী আইনজীবী সৈয়দ মহিদুল কবীর।