কক্সবাজারে স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে পর্যটককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুই জনকে শনাক্ত করেছে র্যাব। তারা হলো, কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকার আব্দুল করিমের ছেলে আশিকুল ইসলাম আশিক ও তার সহযোগী ইস্রাফিল হুদা জয়। র্যাব ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, তারা ছিনতাইকারী। তবে স্থানীয়রা বলছেন, কক্সবাজারে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের মূলহোতা আশিক। তার নেতৃত্বে রয়েছে ৩২ জনের একটি অপরাধী চক্র।
শহরের বাহারছড়া এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত আশিকুল ইসলাম আশিক বড় ধরনের অপরাধী। তার রয়েছে ৩২ জনের সিন্ডিকেট। তারা একেকজন একেকভাবে বিভক্ত হয়ে, আবার কখনও দুই-তিন জন দলভুক্ত হয়ে শহরের অলিগলিতে চুরি, বিচে ছিনতাই ও খুনসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়। একজন ধরা পড়লে সিন্ডিকেটের আরেকজন এগিয়ে গিয়ে রক্ষা করে। চুরি-ছিনতাইয়ের মামলায় কয়েক মাস আগে আশিকুল ইসলাম আশিক গ্রেফতার হয়। কয়েক দিন আগে জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে আশিক। মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। সবশেষ পর্যটক ধর্ষণে জড়ায়। তাকে গ্রেফতার করলেই সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।
পুলিশ ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, আশিকুল ইসলাম আশিক ও তার সহযোগী ইস্রাফিল হুদা জয় ছিনতাইকারী। আশিকের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা রয়েছে। তার সহযোগীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা আছে। আশিক একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছে।
ধর্ষণের শিকার নারীর ভাষ্য, ‘স্বামী-সন্তান নিয়ে বুধবার সকালে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে পৌঁছেন। ওঠেন শহরের হলিডে মোড়ের একটি পাঁচতলা হোটেলে। ওই দিন বিকালে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে লাবণী বিচে যান। রাতে হোটেলে ফেরার পথে এক যুবকের সঙ্গে তার স্বামীর ধাক্কা লাগে। এতে স্বামীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে ওই যুবক। বাধা দিলে তার সঙ্গেও তর্কে জড়ায় যুবক। ওই সময় আরও দুই যুবক ঘটনাস্থলে এসে হাজির হয়। তারা স্বামী-সন্তানকে ইজিবাইকে তুলে দিয়ে ওই নারীকে আলাদা করে ফেলে। পরে ওই এলাকার একটি ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে তিন জনে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এরপর স্বামী-সন্তানকে হত্যার ভয় দেখিয়ে একটি হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে এক যুবক স্ত্রী পরিচয় দিয়ে তাকে হোটেলের রুমে নিয়ে আবারও ধর্ষণ করে। শেষে রুমের দরজা বাইর থেকে আটকে পালিয়ে যায়। হোটেল থেকে বেরিয়ে ৯৯৯ নম্বরে কল করেন ওই নারী। পুলিশের কোনও সহায়তা না পেয়ে র্যাবকে খবর দেন। তখন হোটেলে আসে র্যাব।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে শহরের কলাতলী এলাকার জিয়া গেস্ট ইন হোটেলের ফ্রন্ড ডেস্কে থাকা ম্যানেজার আমির হোসেন ও তামজিদ আল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘বুধবার রাতে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে আশিকুল ইসলাম আশিক ও সাথী নামে দুই জন রুম ভাড়া নেয়। একঘণ্টার মধ্যে রুম ছেড়ে চলে যায় তারা। হোটেলের রেজিস্টারে তাদের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁও থানার মাইজপাড়া গ্রাম। রাতে র্যাব আসার পর জানতে পারি আশিকুল ইসলাম আশিকের বাড়ি বাহারছড়া এলাকায়। আশিকই ওই নারীকে নিয়ে হোটেলে এসেছিল। এর বেশি কিছু আমরা জানি না।’
ওই নারীর ভাষ্য অনুযায়ী, প্রথমে সৈকতের লাবণী পয়েন্টের সানি বিচ এলাকার ঝুপড়ি ঘরে তাকে ধর্ষণ করেছে তিন যুবক। বৃহস্পতিবার বিকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায় সুনসান নীরবতা, স্তব্ধ ওই এলাকা। আশপাশে লোকজন নেই।
কিছু দূর যাওয়ার পর নুরুল হক নামে স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে কথা হয়। নুরুল হক বলেন, ‘ধর্ষণের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে প্রতিরাতে সৈকতের বিচ ও ঝাউবাগানে গাঁজা ও জুয়াড়িদের আসর বসে। শহরের সব ছিনতাইকারী, নেশাখোর ও অপরাধী এখানে আড্ডা দেয়। বুধবার রাতেও এখানে তারা চেঁচামেচি করেছিল। আমরা ভয়ে বাসা থেকে বের হইনি। কারণ, প্রায় দুর্ঘটনা ঘটে। আমার ধারণা, ওই সময়ে এখানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল মঞ্জুর বলেন, ‘সন্ধ্যা হলেই লাবণী বিচ থেকে শুরু করে কবিতা চত্বর ও ডায়াবেটিক পয়েন্ট এবং ঝাউবাগানের আশপাশে কোনও নিরাপত্তা থাকে না। বলতে গেলে অপরাধীদের দখলে থাকে এসব এলাকা। ফলে এসব এলাকায় প্রতিনিয়ত কোনও না কোনও অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব এলাকায় জেলা পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশের কোনও তৎপরতা নেই। এখানে পুলিশ নিষ্ক্রিয়। জেনেও ব্যবস্থা নেয় না তারা।’
আবুল মঞ্জুরের কথার সত্যতা মিলেছে কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে কথা বলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পর্যটক বলেছেন, সন্ধ্যা হলেই ভুতুড়ে এলাকা মনে হয়। কোনও লোকজন নেই। অপরাধী ও ছিনতাইকারীরা আড্ডা দেয়। জেলা পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশের তৎপরতা আমাদের চোখে পড়েনি।
জানতে চাইলে ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের অতিরিক্ত সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পর্যটক ধর্ষণের বিষয়টি জানার পরপরই ট্যুরিস্ট পুলিশ তদন্ত শুরু করে। যেহেতু মামলা হয়নি সেহেতু আমরা এখনও ঘটনার গভীরে যেতে পারেনি। তবে আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি।’
ঝাউবাগান ও বিচে পর্যটকদের নিরাপত্তা না থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ঝাউবাগানের শৈবাল ও কবিতা চত্বরে পুলিশ বক্স রয়েছে। সেখানে পুলিশ নিয়মিত টহলে থাকে। সেখানে অপরাধীদের বিচরণ কিংবা আড্ডা দেওয়ার সুযোগ নেই।’
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি সঠিক নয়। হোটেল মোটেল জোনে যে নারী ধর্ষণের অভিযোগে ৯৯৯ ফোন দেওয়ার কথা বলছেন, তা আমরা জানি না। কারণ, ৯৯৯ থেকে জেলা পুলিশের কাছে কোনও ফোন আসেনি। তারপরও খবর পেয়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং ভিকটিমের সঙ্গে কথা বলেছেন। ভিকটিম যদি থানায় মামলা দেন তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, আশিকুল ইসলাম আশিকের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা রয়েছে। তার সহযোগী জয়ের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। আশিক একাধিকবার গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিল। পরে জামিনে বের হয়েছে।
র্যাব-১৫ কক্সবাজারের অধিনায়ক লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘পর্যটক ধর্ষণের বিষয়টি জানার পরপরই র্যাবের একটি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়। জিয়া গেস্ট ইন হোটেল থেকে ওই নারীকে উদ্ধার করেছি আমরা। উদ্ধার হওয়ার পর ওই নারী র্যাবকে জানান, তার আট মাসের সন্তান ও স্বামীকে জিম্মি করে হত্যার ভয় দেখিয়ে জিয়া গেস্ট ইন হোটেলে ধর্ষণ করেছিল। পরে ওই নারীকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করেছি। র্যাব তদন্ত করে দুই জনকে শনাক্ত করেছে। তাদের দ্রুত গ্রেফতার করা হবে।’
কক্সবাজার র্যাব-১৫ সিপিসি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান বলেন, পুরো ঘটনা তদন্ত করে এবং সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ঘটনায় জড়িত দুই জনকে শনাক্ত করেছি। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জিয়া গেস্ট ইন হোটেলের ম্যানেজার রিয়াজ উদ্দিন ছোটনকে আটক করা হয়েছে। শনাক্তকারীদের ধরতে র্যাবের অভিযান অব্যাহত আছে।’