আল্লাহর ইবাদত করে আমৃত্যু ঈমানের ওপর অটল থাকা মানুষের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য। তবে ঈমান ও আমল নিয়ে কখনো অহংকার করা যাবে না। অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না। কারণ কেউ-ই জানে না তার মৃত্যু কী অবস্থায় হবে। হতে পারে যে লোকটি আজ মোটেই নামাজ পড়ছে না, দ্বিন-ধর্মের ধারে-কাছে নেই, মৃত্যুর আগে আল্লাহ তাকে তাওবার সুযোহ দিলে সে জান্নাতবাসী হয়ে যাবে। আবার কেউ সারা জীবন ইবাদত-বন্দেগি করে মৃত্যুর আগে (নাউজুবিল্লাহ) এমন কাজে লিপ্ত হল, যে তার সারা জীবনের আমল বৃথা হয়ে যায়।
এর বাস্তব উদাহরণ সাহাবায়ে কেরামের যুগেই দেখা গেছে। সাহাল ইবনে সাদ সাঈদি (রা.) থেকে বর্ণিত, (খাইবারের যুদ্ধে) রাসুল (সা.) এবং মুশরিকরা মুখোমুখি হলেন। পরস্পরের মধ্যে তুমুল লড়াই হলো। (দিন শেষে) রাসুল (সা.) তাঁর সেনা ছাউনিতে ফিরে এলেন আর অন্যপক্ষও তাদের ছাউনিতে ফিরে গেল। রাসুল (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি তার তরবারি থেকে একাকী কিংবা দলবদ্ধ কোনো শত্রু সৈন্যকেই রেহাই দেননি। বরং পিছু ধাওয়া করে তাকে তরবারির আঘাতে হত্যা করেছেন। তাদের কেউ বলেন, অমুক ব্যক্তি আজ যা করেছে আমাদের মধ্যে আর অন্য কেউ তা করতে সক্ষম হয়নি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কিন্তু সে তো জাহান্নামি। সাহাবিদের একজন বলেন, (ব্যাপারটা দেখার জন্য) আমি তার সঙ্গী হব।
নিজ তরবারির আঘাতে ব্যক্তির মৃত্যু : সাহা ইবনে সাদ সাঈদি (রা.) বলেন, পরে তিনি ওই লোকটির সঙ্গে বের হলেন, লোকটি থামলে তিনিও থামতেন, লোকটি দ্রুত চললে তিনিও দ্রুত চললেন। বর্ণনাকারী বলেন, একসময় লোকটি ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলো এবং (যন্ত্রণায় ও কষ্টে) দ্রুত মৃত্যু কামনা করতে থাকে। তাই সে তার তরবারির গোড়ার অংশ মাটিতে রেখে এর ধারালো দিক বুকের মাঝে রাখল। এরপর সে তরবারির ওপর নিজেকে জোরে চেপে ধরে আত্মহত্যা করল। তখন লোকটি (অনুসরণকারী সাহাবি) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসুল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ব্যাপার কী? তিনি বলেন, একটু আগে আপনি যে লোকটির কথা বলেছিলেন যে লোকটি জাহান্নামি, তাতে লোকেরা আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল। তখন আমি তাদের বলেছিলাম, আমি লোকটির পিছু নিয়ে দেখব। কাজেই আমি বিষয়টির খোঁজে বেরিয়ে পড়ি। একসময় লোকটি মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলো এবং শিগগিরই মৃত্যু কামনা করল, তাই সে তার তরবারির হাতলের দিক মাটিতে বসিয়ে এর তীক্ষ্ম ভাগ নিজের বুকের মাঝে রাখল। এরপর নিজেকে তার ওপর জোরে চেপে ধরে আত্মহত্যা করল। এ সময় রাসুল (সা.) বলেন, ‘অনেক সময় মানুষ জান্নাতিদের মতো আমল করতে থাকে, যা দেখে অন্যরা তাকে জান্নাতিই মনে করে। অথচ সে জাহান্নামি। আবার অনেক সময় মানুষ জাহান্নামিদের মতো আমল করতে থাকে, যা দেখে অন্য মানুষও তেমনই মনে করে থাকে, অথচ সে জান্নাতি। (বুখারি, হাদিস : ৪২০৩)
তাই কখনোই নিজের আমলের ওপর অহংকার করে নিজেকে পৃথিবীর একমাত্র জান্নাতি ব্যক্তি বা নেককার মানুষ ভাবার সুযোগ নেই। বরং সর্বদা আল্লাহকে ভয় করতে হবে, তাঁর রহমতের আশায় থাকবে। মুক্তি একমাত্র তাঁরই হাতে। তিনি ঈমানি মৃত্যু না দিলে সারা জীবনের সমস্ত আমল বিফলে চলে যাবে।
মৃত্যুর আগেও মানুষের ভাগ্য যেভাবে বদলে যায় : আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) যিনি ‘সত্যবাদী’ এবং ‘সত্যবাদী বলে স্বীকৃত’ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টি হলো এমন বীর্য থেকে, যাকে মায়ের পেটে চল্লিশ দিন কিংবা চল্লিশ রাত একত্র রাখা হয়। তারপর তেমনি সময়ে ‘আলাক’ হয়, তারপর তেমনি সময়ে গোশতপিণ্ডে পরিণত হয়। তারপর আল্লাহ তার কাছে ফেরেশতা প্রেরণ করেন। এই ফেরেশতাকে চারটি বিষয় সম্পর্কে লেখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে ফেরেশতা তার রিজিক, আমল, আয়ু এবং দুর্ভাগা কিংবা ভাগ্যবান হওয়া সম্পর্কে লিখে দেয়। তারপর তার মধ্যে প্রাণ ফুঁকে দেওয়া হয়। এ জন্যই তোমাদের কেউ জান্নাতিদের আমল করে এতটুকু এগিয়ে যায় যে তার ও জান্নাতের মাঝে শুধু এক গজের দূরত্ব থাকতেই তার ওপর লিখিত তাকদির প্রবল হয়ে যায়। তখন সে জাহান্নামিদের মতো আমল করে। শেষে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। আবার তোমাদের কেউ জাহান্নামিদের মতো আমল করে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে তার ও জাহান্নামের মাঝে মাত্র এক গজের দূরত্ব থাকতে তার ওপর তাকদিরের লেখা প্রবল হয়, ফলে সে জান্নাতিদের মতো আমল করে, শেষে জান্নাতেই প্রবেশ করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৫৪)
ভালো আমল করা মানুষের কর্তব্য : তবে এর মানে কি এই যে ভাগ্যের ওপর সব কিছু কোনো আমল না করে বসে থাকবে? এ প্রশ্ন সাহাবায়ে কেরামের মনেও উদিত হয়েছিল। আলী (রা.) বলেন, এক জানাজায় রাসুল (সা.) উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তিনি কিছু একটা হাতে নিয়ে তা দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বলেন, তোমাদের মধ্যে এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যার স্থান হয় জান্নাতে বা জাহান্নামে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়নি। এ কথা শুনে সবাই বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা তাহলে আমল বাদ দিয়ে আমাদের লিখিত ভাগ্যের ওপর কি ভরসা করব? উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা আমল করতে থাকো। কারণ যাকে যে আমলের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তার জন্য সে আমলকে সহজ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি সৌভাগ্যবান হবেন, তার জন্য সৌভাগ্যবান লোকদের আমলকে সহজ করে দেওয়া হবে। আর যে দুর্ভাগা হবে, তার জন্য দুর্ভাগা লোকদের আমলকে সহজ করে দেওয়া হবে। এরপর তিনি পাঠ করেন, সুতরাং কেউ দান করলে, মুত্তাকি হলে এবং যা উত্তম তা গ্রহণ করলে, আমি তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ। এবং কেউ কার্পণ্য করলে, নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করলে, আর যা উত্তম তা ত্যাগ করলে, তার জন্য আমি সুগম করে দেব কঠোর পরিণামের পথ। (বুখারি, হাদিস : ৪৯৪৯)
তাই আমলের ওপর ভিত্তি করে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ না ভেবে সর্বদা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া উচিত।