শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৩ অপরাহ্ন

গ্লানি শিশুরক্তের

Reporter Name
  • Update Time : সোমবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২১
অবোধ শিশু, তোর জন্য
আমিও কেঁদেছি
খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা
একদিন তুলেছিল আকাশ ফাঁটানো জয়ধ্বনি
তারাই দুদিন বাদে থুতু দেয়, আগুন ছড়ায়-
বয়স্করা এমনই উন্মাদ!
তুই তোর গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়েসেতে ছিলি।
তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচী হলো
শিশুরক্তপানে গ্লানি নেই?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাটি যত পড়ি, এক সামগ্রিক বিপন্নতায় আক্রান্ত হই। ভেতরে ভেতরে প্রতিধ্বনিত হয় একটি বাক্য: ‘বয়স্করা এমনই উন্মাদ!’
যে শিশু তার মায়ের কোলে ফিরে যেতে চেয়েছিল, সে-মতে আশ্বস্তও করা হয়েছিল, তাকে বুলেটে ঝাঝরা করে দিতে ঘাতকের বুক একবারও কাঁপেনি। এই শিশুরক্তের প্রবাহ আজ বিশ্বময়। আমি সুনীলের মতো ‘আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই’ বলি বার বার।
পৃথিবীতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নতুন কিছু নয়। অনেক রাষ্ট্রনায়ক গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে সপরিবারে, এমনকি মাসুম বাচ্চাটাও বাদ যায় না- এমন হত্যাকাণ্ড বিরল। এমন নয় সেই রাষ্ট্রনায়ক সামরিক শক্তির জোরে ক্ষমতায় বসেছেন। তিনি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। সারা জীবনের সংগ্রামে নিজের দেশকে স্বাধীন করেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছেন একটি দেশ বিনির্মাণের। সেই নেতাকে রাতের অন্ধকারে সপরিবারে হত্যা একটি  জাতিকে কলঙ্কিত করে দেয়। লজ্জার কালিমা লেপে দেয় সভ্যতার মুখে।
সেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনার ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইটি পড়ছিলাম। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের পাঁচ-ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রাসেল। ছোট্ট রাসেল আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। মা রাসেলকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সংসারের কাজ করতেন, স্কুল বন্ধ থাকলে তার পাশে শুয়ে আমি বই পড়তাম। আমার চুলের বেণি ধরে খেলতে খুব পছন্দ করত ও। আমার লম্বা চুলের বেণিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিতাম। ও হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হাসত। কারণ, নাড়াচাড়ায় মুখে চুল লাগতো তাতে খুব মজা পেত।’
রাসেলের স্বপ্ন ছিল মেঝ ভাই শেখ জামালের মতো আর্মির অফিসার হওয়ার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘রাসেলের খুব শখ ছিল সে বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবে এবং সেভাবে কিন্তু সে নিজেকে তৈরি করত। ছোট ছোট গরিব শিশুর প্রতি তার দরদ ছিল। যখন সে গ্রামে যেত গ্রামের অনেক শিশুকে সে জোগাড় করত। সে কাঠের বন্দুক বানাত। শিশুদের জন্য মাকে বলত কাপড় কিনে দিতে হবে। মা ঠিকই কিনে দিতেন। বাচ্চাদের সে প্যারেড করাতো।’
১১ বছরের যে শিশুটি স্বপ্ন দেখত আর্মি অফিসার হওয়ার- তার সামনেই আর্মির লোকজন যখন বন্দুক তাক করল, তার মনে সেনাবাহিনী নিয়ে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। প্রায়ই মনে মনে ভাবি। বিপদে নাকি মানুষের দ্রুত মানসিক পরিবর্তন আসে। তাই এতটুকুন একটা বাচ্চা ঘাতকদের কাছে প্রাণভিক্ষা করে বলেছিল, ‘আল্লাহ’র দোহাই আমাকে জানে মেরে ফেলবেন না। আমার হাসু আপা দুলাভাইয়ের সঙ্গে জার্মানিতে আছেন। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি, দয়া করে আপনারা আমাকে জার্মানিতে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিন।’
বেঁচে থাকার কী আঁকুতি! চোখে পানি এসে যায়। কিন্তু তাতে সীমারের মন গলেনি। তাঁকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে।
গল্পটা এতটুকুন হলে কথা ছিল না। মাসুম বাচ্চাটির হত্যার যেন বিচার না হয় সেজন্য আইন করা হয়েছিল। খুনিদের বাঁচানোর জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে। খুনির পক্ষে দাঁড়াতে পারে কোনো সভ্য সমাজ, সে ধারণা ততদিন সারাদুনিয়ার ছিল না- সেটাও করে দেখালাম আমরা।’
কী লজ্জা কী কলঙ্কের অতীত নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। জাতির পিতার হত্যা, ১১ বছর বয়সী এক শিশু হত্যা, গর্ভবতী এক নারী হত্যা- সব বৈধ হয়ে গেল। রাষ্ট্র খুনিদের করল পুরস্কৃত।
১৯৭১-এ দেশ স্বাধীনের পর মানুষ একটা সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখত। দেশটাকে বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখত। দুর্নীতি তখনও ছিল। কিন্তু দেশটাকে ভাগাড় ভাবত না। ভাবত না এই দেশে থাকা যাবে না।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশের অনেক লোক দেখানো উন্নতি হয়েছে। অনেকেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। দুর্নীতি পেয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। সব ঠিক আছে, কিন্তু অলক্ষে একটি জিনিস হয়ে গেছে, এই দেশ নিয়ে সবাই স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছে। দেশটিকে লুটের বাতাসা ধরে নিয়েছে সবাই। লুটপাট করে বিদেশে পাঠাতে হবে। সন্তান-সন্তুতিকে রাখতে হবে বিদেশে। এমনকি ঘাতকরাও অনুকূল পরিবেশ পেয়েও দেশে থাকতে চায়নি।
এর কারণ কী? কারণ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এই দেশের মানুষের মন থেকে ন্যূনতম নিরাপত্তাবোধ চলে গেছে। একটি দেশের গ্রহণযোগ্যতা নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। যেদেশে ১১ বছরের একটি শিশু প্রাণভিক্ষা চেয়ে বাঁচেনি, সেই দেশে আমার আপনার কী নিরাপত্তা আছে- এই বোধ সবার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। শিশু রাসেল পুরো একটি দেশকে বিশাল প্রশ্নের মুখোমুখি রেখে দিয়ে চলে গেছে। এই আস্থার সংকট সম্ভবত এখনও কাটেনি। এখনও স্বচ্ছল পরিবারগুলো তাদের সন্তান বিদেশে পাঠিয়ে দেন নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে। একটি জাতি যেন একটা আদিপাপের বোঝা কাঁধে নিয়ে বেড়াচ্ছে। রাসেল পুরো জাতিকে অপরাধী করে গেছে। তার রক্তে লাল হয়ে আছে বাংলাদেশের মুখ।

এইচ বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর এ আপনাকে স্বাগতম। “সময়ের প্রয়োজনে- HBD NEWS24” নিয়ে আমরা আছি আপনার পাশে। আপনার পাশে ঘটে যাওয়া নানা সংগতি, অসংগতি আর তথ্য নিয়ে আপনিও যোগ দিন HBD NEWS 24 এ আমাদের কাছে মেইল করুন: hbdnews24@yahoo.com

More News Of This Category

© All rights reserved © 2012 HBDNEWS24

POWERED BY MH GROUP OF COMPANY.