ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলের বেড়িবাঁধ। জলোচ্ছ্বাসে পানিতে ভাসে গ্রামের পর গ্রাম। ঘর ছাড়া হয় হাজার হাজার পরিবার। মাঠের ফসল, চাষের মাছ হারিয়ে পথে বসে লাখ লাখ ব্যবসায়ী।
ভোগান্তির শিকার স্থানীয়রা বলছেন, প্রত্যেক বন্যায় জোড়াতালি দেওয়া বেড়িবাধেঁর কোনো না কোনো অংশ ভাঙবেই। বছরের পর বছর সেই ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে প্রবেশ করা পানিতে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম।
বরগুনা জেলার সদর উপজেলার ফুলঝুড়ি বাঁধ, লতাবাড়িয়া-মোল্লারহোড়া বাঁধ, জাঙ্গালিয়া বাঁধ, বালিয়াতলী বাঁধ, পালের বালিয়াতলী বাঁধ, আয়লা-পাতাকাটা বেড়িবাঁধ ঝূকিপূর্ণ। পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা বেডিবাঁধ, জিনতলা বাঁধ, পরিঘাটা বাঁধ, কালমেঘা ও কাকচিড়া বেড়িবাধ জোড়াতালি দেওয়া। বেতাগী পৌর শহররক্ষা বাঁধ ও কালিকাবাড়ী বাঁধ; আমতলী উপজেলার ঘটখালী বাঁধ; তালতলী উপজেলার তেতুলবাড়িয়া বাঁধ, জয়ালভাঙা ও খোট্টারচড় এলাকার বেড়িবাধ মারাত্মক ঝূঁকিপূর্ণ।
বরগুনার সদর উপজেলার ফুলঝুড়ি গ্রামের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম স্বপন রাইজিংবিডিকে বলেন, ফুলঝুড়ি বেড়িবাঁধ দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে ঝূঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। একাধিকার জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, সংসদ সদস্যরা পরিদর্শন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ভাঙা বেড়িবাঁধ নিয়ে দিন-রাত আতঙ্কে থাকেন তারা। এই মনে হয় জোয়ারের পানিতে ভেসে গেল সব। জোড়াতালি দেওয়া বাঁধ ভেঙে গেলো। ঘূর্ণিঝড়ের সময় তাদের এলাকার মানুষের অবস্থা খুব খারাপ হয়। সুপার সাইক্লোন সিডরে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এই এলাকার।
একই এলাকার বাসিন্দা রাসেল হোসেন, সোহরাব হোসেনসহ কয়েকজন কৃষক রাইজিংবিডিকে বলেন, প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের পানির চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড এসে মেরামত করে। এই অস্থায়ী মেরামত তেমন উপকারে আসে না। ভোগান্তির শেষ থাকে না মানুষের। ফসল পানিতে নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে কৃষি থেকে সরে আসতে হবে তাদের।
লতাবাড়িয়া, মোল্লারহোড়া গ্রামের বাসিন্দা অপু মোল্লা রাইজিংবিডিকে বলেন, স্বাধীনতার আগে অস্থায়ীভাবে এই এলাকায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করে তৎকালীন সরকার। তারপর বার বার ভেঙেছে, আর প্লাবিত হয়েছে ১০ গ্রামের মানুষ। নষ্ট হয়েছে ফসলি ক্ষেত ও মাছের ঘের।
সদর উপজেলার জাঙ্গালিয়া গ্রামের তুহিন পহলান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সিডর, আইলাসহ প্রত্যেক ঘূর্ণিঝড়ে জাঙ্গালিয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙেছে। সবশেষ ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াশের’ প্রভাবে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় ৬ গ্রামের মানুষ। এই ভোগান্তির শেষ হবে না। বাবা-দাদারাও পানিতে ভেসেছে, আমরাও ভাসি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও ভাসবে।’ স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করলে এই সমস্যার সমাধান হতো বলে মনে করেন তারা।
তালতলী উপজেলার তেতুলবাড়িয়া গ্রামের মোতালেব মিয়া, জাহিদ হাসানসহ কয়েকজন বলেন, বুড়িশ্বর নদীর ভাঙনে এই এলাকার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যখন ঘূর্ণিঝড় হয়, তখন এই বাঁধ ভেঙে যায়। ঘূর্ণিঝড় সিডরে এলাকার অন্তত ৩০০ মানুষ প্রাণ হারায়। অনেকে ভেসে গিয়েছে। তাদের মৃতদেহও পাওয়া যায়নি।
পাথরঘাটা উপজেলার জীনতলা গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য জসিম উদ্দিন রাইজিংবিডিকে বলেন, বার বার জিনতলা বাঁধ ভেঙে যায়। যতবার ভাঙে ততবার জরুরি মেরামত করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যে টাকা দিয়ে বার বার জরুরি মেরামত করে, সেই টাকা দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা যায়। এই ভোগান্তি থেকে পরিত্রাণ চান তারা।
একই গ্রামের কৃষক খোকন মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘একটু লাভের আশায় ধান চাষ করি। বন্যার পানিতে কখনও ভেসে যায় সোনালী ফসল, কখনও ভেসে যায় বীজতলা। এখন পথে বসে গেছি। স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করলে আমরা বাচঁতে পারতাম। আমরা বাঁচতে চাই।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৯৬০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে ৩৩টি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। প্রত্যেকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলের বাঁধ। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বরগুনা উপকূল বহুবার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে।
বরগুনা উপকূলে ব্রিটিশ আসলে ও পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে নির্মাণ করা হয় অস্থায়ী ৮০৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। একদিকে ঘূর্ণিঝড়, অন্যদিকে নদীভাঙন ও জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে এ সব বাঁধ। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্যমতে, উপকূলের ৮০৫ কিলোমিটার বেড়িবাধেঁর মধ্যে স্থায়ীভাবে নির্মাণ হয়েছে মাত্র ১২ কিলোমিটার। বাকি পুরোটা অস্থায়ী বাঁধ।
বরগুনা কৃষি অফিসের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ এস এম বদরুল আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, কয়েকমাস আগে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াশের’ প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের লবণপানিতে ফসল নষ্ট হয়। যার আর্থিক ক্ষতি ১২ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পানের’ প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে জেলার ২০৬ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। আর্থিক ক্ষতি হয়ে ৬১ কোটি ৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকার। ২০১৯ এ ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুলের’ কারণে ৩০০ হেক্টর জমির ৫ হাজার ৪১০ মেট্রিক টন ফসল নষ্ট হয়। একই বছরে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’তে নষ্ট হয় ১৬ হেক্টর জমির ফসল।
উপ-পরিচালক কৃষিবিদ এস এম বদরুল আলম বলেন, জেলার কৃষি রক্ষায় দ্রুত স্থায়ীভাবে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের বিকল্প নেই। প্রতিবছর কৃষকরা এমন ক্ষতির মুখে পড়লে তারা কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। উৎপাদন কমে যাবে।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কাইছার আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, এক কিলোমিটার স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণে খরচ হয় ২৫ কোটি টাকা। বড় প্রকল্প নেওয়া ছাড়া স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ সম্ভব না। তাই তারা কিছু করতে পারছেন না।
নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ছোট ছোট যা বরাদ্দ আসে তা দিয়ে বেড়িবাঁধ মেরামত করে উপকূলবাসীকে জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেন তারা। গত দুই বছরে একাধিকবার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য মৌখিক ও লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তবে এখনও বড় প্রকল্প নেওয়া হয়নি।