তীরের উপজেলা পাথরঘাটা। সেখানকার বাসিন্দা মিলা আক্তার। কয়ের দিন ধরে রাত্রিজ্বরে ভুগছিলেন। সকালে ভাতের পরিবর্তে মাত্র দুই পিস বিস্কুট খেয়েছিলেন। এরপরই শুরু হয় পেটে ব্যথা, সঙ্গে পাতলা পায়খানা। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বমি নামক উপসর্গ যুক্ত হয়। রোগমুক্তি পেতে পাশের মঠবাড়িয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। সেখানে দুই দিন থাকার পর তার অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে মিলার ঠাঁই হয়েছে বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের আঙিনায়।
শুধু মিলাই নন, ডায়রিয়ার চিকিৎসা নিতে আসা অন্তত ২০ ভাগ রোগী পাতলা পায়খানা সাথে জ্বরে আক্রান্ত। যা করোনাভাইরাসেরও উপসর্গ।
বরিশাল জেনারেল হাসপাতালে করোনার পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় ওই সব রোগীদের নিয়ে চিকিৎসকরাও শঙ্কিত। প্রতিদিন শুধু জেনারেল হাসপাতালেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে প্রায় ১০০ জন। আর পুরো বিভাগে আক্রান্তের সংখ্যা এর অন্তত ১০ গুণ। হঠাৎ করে রোগী বেড়ে যাওয়ায় স্থান সংকুলান হচ্ছে না হাসপাতালে। নেই ডায়রিয়া রোগীর জন্য দরকারি আইভি স্যালাইনের মজুদ।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে করোনার সাথে বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ২৭ হাজার ৬৫২ জন। মৃত্যু হয়েছে অন্তত পাঁচজনের। তাই করোনার ন্যায় ডায়রিয়ার চিকিৎসার বেলায়ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে ‘হ য ব র ল’ অবস্থা।
রোগীর তুলনায় ডায়রিয়া ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত বেড ও জায়গা না থাকায় হাসপাতাল চত্বরে অস্থায়ী প্যান্ডল তৈরি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের জন্য সরকারিভাবে আইভি স্যালাইন সরবরাহ করার কথা থাকলেও, তা বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে রোগীদের। আর রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক আর নার্সদের।
২০ ভাগ রোগীর করোনা উপসর্গ
বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মলয় কৃষ্ণ বড়াল বলেন, ১৫ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৩৬০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। ভর্তি হওয়া রোগীদের অনেকে বাড়িতেই স্যালাইন খায়, পরিস্থিতি খুব খারাপ হলে বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে হাসপাতালে আসে। ভর্তি হওয়া রোগীদের অন্তত ২০ ভাগের শরীরে করোনার উপসর্গ দেখা গেছে। হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই।
ডা. মলয় কৃষ্ণ বড়াল আরো বলেন, যারা ভর্তি হচ্ছেন, তাদের অন্তত ৬০ ভাগ রোগী প্রবল ডায়রিয়া বা কলেরা নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের শরীরে করোনার উপসর্গ দেখা গেলেও ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পরীক্ষার জন্য পাঠানো যাচ্ছে না। তবে করোনার উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া ডায়রিয়ার রোগীদের আলাদা রাখা হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর’বি) চিকিৎসক দীপংকর দাসের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি টিম সোমবার বরিশালে কাজ শুরু করেছে।
শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, জ্বর-কাশির মতো ডায়রিয়াও করোনার একটি উপসর্গ। করোনা ওয়ার্ডে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন, সম্প্রতি তাদের মধ্যেও ডায়রিয়ার লক্ষণ দেখা গেছে। তবে সেই ডায়রিয়ার মাত্রা ততটা ভয়াবহ পর্যায়ে শতকরা হিসেবে তারা বিষয়টি ভেবে দেখেননি। তবে স্বল্পমাত্রার ডায়রিয়া আক্রান্ত করোনা রোগীর হার শতকরা ১০ ভাগের মতে হতে পারে। তবে এই হার দিন দিন বাড়বে।
কলেরার পরিস্থিতি
বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের একটি কক্ষের চারটি শয্যা নিয়ে ডায়রিয়া বা কলেরা ওয়ার্ড পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিদিন সেখানে গড়ে ১০০ বা তার বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এদের মধ্যে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ প্রবল ডায়রিয়া বা কলেরা রোগী। যারা বিভিন্ন জেলা কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে কলেরা ওয়ার্ডে আসছেন। রোগীদের মধ্যে অন্তত ৬০ ভাগ নারী।
কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর সংখ্যা আরো বাড়বে। যদিও চার শয্যার হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থায় ৩০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে ১০০ জনের বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাই শয্যা না পেয়ে অনেক রোগীর ঠাঁই মিলছে বারান্দায়, কিংবা হাসপাতালের আঙিনায়।
এদিকে বাকেরগঞ্জ, মীর্জাগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশ কয়েক দিনে খাওয়ার স্যালাইনের বিক্রি বেড়েছে। অনেকেই আগেভাগে খাওয়ার স্যালাইন কিনে রেখেছেন। এতে করে খাওয়ার স্যালাইনের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। তবে উপজেলা পর্যায়ে আইভি স্যালাইনের প্রচণ্ড সংকট দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ ১০০ টাকার স্যালাইন তিনগুণ দামে কিনে রাখছেন। বরিশাল সদর হাসপাতাল থেকে জনপ্রতি রোগীকে দুটি করে আইভি স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। অপর আইভি স্যালাইন বাইরে থেকে অধিক দামে কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।
বিভাগের পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৬৯৩। তবে ১৮ এপ্রিল এর মধ্যে ডায়রিয়ায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। তা ছাড়া সাড়ে তিন মাসে বিভাগের ছয় জেলার মধ্যে বরিশালে ৩ হাজার ২১৭, পটুয়াখালীতে ৫ হাজার ৯২০, ভোলায় ৬ হাজার ৬০৬, পিরোজপুরে ৩ হাজার ৪৮৬, বরগুনায় ৪ হাজার ৪০ ও ঝালকাঠিতে ২ হাজার ৪২৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। তবে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে, এমন রোগী হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চেয়ে অনেক বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৮ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল এক মাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে, যা মোট আক্রান্তের প্রায় অর্ধেক। এই সংখ্যা ১২ হাজার ৮৯৬। আবার এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আক্রান্তের গতি আরো বেড়েছে। দ্বিতীয় সপ্তাহে, অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাত দিনে বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ৫৭৭ জন। তিনজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে এই সপ্তাহে। এর মধ্যে বরগুনা জেলায় একজন ও অন্য দুজন বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার। তিন দিনের ব্যবধানে আরো দুই রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। এতে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের ওপর চাপ বেড়েছে। ডায়রিয়া বেড়ে যাওয়ার পেছনে আবহাওয়ার বৈপরীত্য বড় কারণ। তাই করোনার পাশাপাশি ডায়রিয়ার বিষয়েও আলাদা নজর রাখা হচ্ছে। বরিশাল বিভাগে খাবার ও আইভি স্যালাইনের সংকট নেই। কিন্তু হঠাৎ করে হাসপাতালগুলোতে রোগী বেড়ে যাওয়ায় সময় মতো স্যালাই সরবরাহ করতে বেগ পেতে হচ্ছে।
ডায়রিয়ার কারণ ও প্রতিকারের উপায়
ডায়রিয়াসহ এই গরমে আরো কিছু সমস্যায় করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন রোগতত্ত বিশেষজ্ঞ ডা. মিজানুর রহমান। তিনি জানান, প্রচণ্ড গরমে মানুষ হিট এক্সরসন বা হিট ক্র্যাম্পে আক্রান্ত হতে পারে। হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সরসন থেকে রোগীর হিট স্ট্রোকও হতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগে মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, মাথা ঘোরে। পরিস্থিতি খারাপ হলে রোগীর বমি হতে পারে, শরীরের তাপমাত্রা ১০৪-১০৫ ডিগ্রি হয়ে যেতে পারে। সাধারণত শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ, যাঁরা প্রচণ্ড গরমের মধ্যে কাজ করেন, তাঁরা এ রোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন। হিট স্ট্রোক থেকে রক্ষা পেতে গরম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. মিজানর রহমান। তিনি জানান, হিট স্ট্রোক হয়ে গেলে রোগীর গা মুছে দিতে হবে।
তবে চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ। বৈশাখেও বৃষ্টির দেখা নেই। তাই গরমও বেড়েছে। গরমে রাস্তার পাশের শরবত পান, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন থাকা, অনিরাপদ পানি পান ও খাবার খাওয়ার কারণে গরমের এই সময়ে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।