প্রায় সব দেশেই এখন মুসলমানের অস্তিত্ব আছে। যেসব দেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপুল জনসংখ্যা ও বহুসংখ্যক মুসলিম দেশের কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। কোনো কোনো মুসলিম রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবেও এগিয়ে, খনিজ সম্পদের কারণে তাদের পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাতারভুক্ত গণ্য করা হয়, পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের মুখাপেক্ষী। আমার বিশ্বাস, মুসলিমরা যদি সত্যিকার এক জাতি হিসেবে কাজ করত, তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা প্রভাব বিস্তার করতে পারত এবং তাদের ব্যাপারে পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন এমন নেতিবাচক হতো না, তাদের এড়িয়ে বৈশ্বিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়াও সম্ভব হতো না। এখন সময়ের দাবি হলো, মুসলিম জনশক্তিকে উম্মাহের সম্পদ ও শক্তিতে পরিণত করা এবং তা থেকে উপকৃত হওয়া।
আল্লাহ মুসলিম জাতিকে সত্যপ্রচারক জাতির মর্যাদা দিয়েছেন। তাদের দৃষ্টান্ত সে পানির মতো যা দিয়ে মানুষ তৃষ্ণা নিবারণ করে, ফসলের মাঠ সিক্ত করে, ফুল ও ফল উৎপাদন করে। কিন্তু এখন মুসলিমরা নিজেদের তৃষ্ণাই নিবারণ করতে পারছে না, তাদের ফসলের মাঠই সজীব নয়। বর্তমান বিশ্বে এমন দেশের সংখ্যা খুবই কম, যেখানে একজন মুসলিম ধর্মীয় জীবনযাপনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না, যেখানে তারা নিজেদের আশ্রয়হীন ও অসহায় ভাবছে না। যেসব দেশ ও অঞ্চলে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, সেখানে তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সংকটাপন্ন এবং যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানেও তারা যথাযথভাবে দ্বিনচর্চা ও তা সমাজে বাস্তবায়নের সুযোগ পাচ্ছে না; বরং দ্বিন প্রতিপালনে তারা নানামুখী বাধা ও সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে।
মুসলিমরা যদি একটি দুর্বল, মূল্যহীন ও জীবনোপকরণ থেকে বঞ্চিত জাতি হতো, তাদের সংখ্যাও খুব কম হতো তবে এমন পরিস্থিতি দেখে মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যেত। অথচ সংখ্যায় মুসলিম পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চাংশেরও বেশি, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রগুলোর এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম, জাতিসংঘে সব মুসলিম রাষ্ট্র যদি কোনো বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ মত দেয় তবে তা খণ্ডন করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রকে তারা যদি বন্ধু ঘোষণা করে তবে কেউ তার পতন ঘটাতে পারবে না, তারা যদি তাদের খনিজ সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে তবে পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের পায়ে পড়ে থাকবে, মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হলে বৈশ্বিক কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তাদের উপেক্ষা করে নেওয়া সম্ভব হবে না।
কিন্তু এখন হচ্ছে কী? মুসলিমরা সব শক্তি, সামর্থ্য, যোগ্যতা ও সম্ভাবনা থাকার পরও বেহাল অবস্থায় রয়েছে। ছোট ছোট দলগুলোও পরস্পর বিবাদে লিপ্ত, তারা এমন শত্রুতায় লিপ্ত যে তা প্রকৃত শত্রুদের মধ্যে থাকে না, এক ভাই অপর ভাইয়ের মুখ পর্যন্ত দেখে না; বরং তাকে পরাজিত করতে শত্রুর সঙ্গে আঁতাত করে। তারা ইসলাম ও উম্মাহর সম্মান ও মর্যাদার পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, মিথ্যা সম্মান ও মর্যাদার জন্য জাতির সম্মান ও মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দেয়; ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সবার কর্মপদ্ধতি একই। এমন অবস্থায় এক জাতির অগ্রগতি কিভাবে সম্ভব?
মুসলিম জাতির করণীয় হলো, নিজেদের দুর্বলতাগুলো কিভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা, উম্মাহর সংস্কারে দ্রুত মনোযোগী হওয়া, বাহিরের শত্রুর চেয়ে ভেতরের শত্রুদের প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়া, ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস তৈরি করা। মুসলিম জাতির শক্তি ও সামর্থ্যের একটি রহস্য হলো, ‘তোমরা ভালো কাজ ও আল্লাহভীতিতে পরস্পরকে সাহায্য করো এবং পাপ ও শত্রুতায় পরস্পরকে সাহায্য কোরো না।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা পরস্পর ক্রোধ, হিংসা, ষড়যন্ত্র ও বিচ্ছিন্নতায় লিপ্ত হয়ো না; বরং তোমরা আল্লাহর বান্দা ও পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৫৮)
যদি শুধু কোরআন ও হাদিসের উল্লিখিত শিক্ষাগুলো অনুসরণ করা হয়, তাহলে মুসলিম জাতির ঐক্য সুদৃঢ় হবে, শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং জীবনযাত্রা উন্নত হবে। মুসলিম উম্মাহর শত্রুরা তাদের সমীহ করবে। শুধু সমীহ নয়; বরং তাদের নেতৃত্ব মেনে নেবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মাত্র ২৩ বছরে এমন একটি দল তৈরি করেছিলেন, যারা এই পৃথিবী বদলে দিয়েছিলেন। অথচ সে দলটি শত্রুর বিপরীতে খুবই ক্ষুদ্র ছিল। তবে তাদের ছিল সীমাহীন ঈমানি শক্তি, আল্লাহর নিঃশর্ত আনুগত্য, নিষ্ঠা ও আত্মোৎসর্গের মানসিকতা।
আজ মুসলিম উম্মাহর কাছে এই শক্তিটিই নেই। তারা জাতির বৃহত্তর স্বার্থ ও আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিজের ব্যক্তি স্বার্থ ও প্রবৃত্তি বিসর্জন দিতে পারে না। স্বার্থসিদ্ধির জন্য জাতির সূর্য সন্তানদের তারা অসম্মান করে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থ বিসর্জন দেয় এবং আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশ অমান্য করে। ফলে প্রথমত জাতি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এরপর ব্যক্তি নিজেরাও লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়।
ঠিক যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘খাদ্য গ্রহণকারীরা যেভাবে খাবারের পাত্রের চতুর্দিকে একত্র হয়, অচিরেই বিজাতিরা তোমাদের বিরুদ্ধে সেভাবেই একত্র হবে। এক ব্যক্তি বলল, সেদিন আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে কি এরূপ হবে? তিনি বললেন, তোমরা বরং সেদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে; কিন্তু তোমরা হবে প্লাবনের স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতো। আর আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের পক্ষ হতে আতঙ্ক দূর করে দেবেন, তিনি তোমাদের অন্তরে ভীরুতা ভরে দেবেন। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল, ‘আল-ওয়াহন’ (ভয়) কী? তিনি বললেন, দুনিয়ার মোহ এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।’ (দাউদ, হাদিস : ৪২৯৭)