ভূমি অফিসের একটি কাগজও রক্ষা পায়নি হেফাজতের আগুন থেকে। সেখানে এখনো পোড়া গন্ধ। সেখানকার হামলা পরিকল্পিত বলেই ধারণা পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে। তাঁরা জানান, ওই অফিসে ঢুকে প্রথমেই সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়। পরে পানির লাইন কেটে ফেলা হয় যেন আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার না করা যায়।
আগুনে সবকিছু পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেয়াল ধসে গেছে সুর সম্রাট ওস্তাদ দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের। হামলাটি পূর্ব পরিকল্পিত বলে অভিযোগ করেন সংগঠনটির সাধারণ মনজুরুল আলম। হামলার সময় গান পাউডারের ব্যবহারের কারণে দেয়াল ধসে পড়ে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডবের ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে দিন যায় বাড়ে তাণ্ডবের মাত্রা। ‘সরকারবিরোধী’ আন্দোলনে এবারই মন্দিরে ভাঙচুর করা হয়েছে। বেছে বেছে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাড়ি।
গত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চের ঘটনার আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১২ জানুযায়ি মাদরাসাছাত্রদের তাণ্ডবে রেলওয়ে স্টেশন, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা ভাষা চত্ত্বরের বিভিন্ন অফিস ভাঙচুর করা হয়। ২০০১ সালে ফতোয়াবিরোধী আন্দোলনে মারা যান ছয়জন। তখন আন্দোলন হলেও এতটা তাণ্ডব হয়নি। কয়েক বছর আগে একটি কনসার্ট আয়োজনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা দেখা দিলেও কোনো ধরণের নাশকতা হয়নি।
এবারের তাণ্ডবে ২৮ মার্চ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলা পরিষদ, পৌরসভা, রেলওয়ে স্টেশন, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন, প্রেস ক্লাব, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, পুলিশ লাইন, সদর থানা, খাঁটি হাতা বিশ্বরোড হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি, শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালী বাড়ি, দক্ষিণ কালী বাড়ি, রেলওয়ে স্টেশন, শিল্পকলা একাডেমি, জেলা আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদস্যের কার্যালয়, সরকারি গণগ্রন্থাগার, গ্যাস ফিল্ড কার্যালয়, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের কার্যালয়, তাঁর নিজের ও শশুরবাড়ি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা চৌধুরী আফজাল হোসেন নেসারের বাড়ি, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আনার, জামাল খানের বাড়ি, বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়ার কার্যালয়, ইউনির্ভাসিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মোকতাদির চৌধুরী মহিলা কলেজ, বিজয়নগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাসিমা মুকাই আলীর বাড়ি, মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, ছাত্রলীগ সভাপতি রুবেল হোসেনের বাড়ি, সাধারণ সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন শোভনের বাড়ি, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ ভাষা চত্ত্বরের উন্নয়ন মেলা, ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল স্কুল, চৌধুরী মঞ্জিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামিসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের উপর হামলা করে আহত করা হয়। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় অন্তত ১২জন নিহত হন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারও এবারের হামলাকে পূর্ব পরিকল্পিত বলে আখ্যায়িত করেছেন। এবারের হামলা একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে বলে উল্লেখ করেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।
একই অভিযোগ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র. আ. ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। হামলার সময় প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ তার।
তবে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর সাজিদুর রহমান জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতির নেতৃত্বে যুবলীগ-ছাত্রলীগের মিছিল জামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসায় হামলা করলে সাধারণ মানুষের মাঝে উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে তাণ্ডবের সঙ্গে হেফাজতের কেউ জড়িত নয় বলে তিনি দাবি করেন।
সেবা বন্ধ :
তাণ্ডবের পর সেবা বন্ধ রয়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে। সদর উপজেলা ভূমি অফিস পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার বসার জায়গাও সেখানে নেই। কথা হলে সহকারি কমিশনার (ভূমি) এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, ‘অফিসের একটি কাগজও অক্ষত নেই। এখানে জমি সংক্রান্ত অনেক রেকর্ড থাকে। যে কারণে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে।’ আপাতত ওই অফিসের সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।
জেলা পরিষদ ও পৌরসভা থেকেও সেবা দান বন্ধ রয়েছে। ওই দুটি প্রতিষ্ঠানে দিনভর ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়। ২৬ মার্চ তাণ্ডবের পর থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে সব ধরণের ট্রেনের যাত্রাবিরতি বাতিল করা হলে যাত্রীদের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু হোরায়রাহ বলেন, ‘একাত্তরের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে নারকীয় এ তাণ্ডব। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনী যতটুকু না করেছে স্বাধীন বাংলার তাদের কিছু দোসর এ ধরণের ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা এর বিচার চাই।’
তাণ্ডবের ঘটনায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও অস্থিরতা বিরাজ বিরাজ করছে। সাংস্কৃতিক কর্মীদের মাঝেও তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন বলেন, ‘পাকিস্তানি দোসররা নারকীয় এ তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত। পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই এ ধরণের হামলা চালানো হয়েছে।’
আত্মরক্ষায় পুলিশ :
২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন নিহত হন। এর মধ্যে প্রথমদিন একজন, দ্বিতীয় দিন পাঁচজন ও তৃতীয় দিন হরতাল চলাকালে তিনজন মারা যান বলে হাসপাতাল সূত্র জানায়। হরতালের দিন হামলা হয় পুলিশ লাইন, সদর থানা, সরাইল খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা ও টোল প্লাজায়। ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানে হামলার সময় পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ওই সময়ই হতাহতের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তুলেনি বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।
একাধিক সূত্র জানায়, পুলিশ লাইন ও সদর থানায় হামলা হলে পুলিশ আত্মরক্ষার কৌশল নেয়। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আপনারা আমাদের ওপর হামলা করবেন না। আমরাও আপনাদেরকে হরতাল পালনে বাধা দিবো না।’
সুর সম্রাট ওস্তাদ দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের সামনে দায়িত্ব পালনকালে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক সদস্যও হরতালের দিন পুলিশের বিরুদ্ধে নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ আনেন। অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হলো পুলিশ কেনা-বেচা হয়েছে। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করলেও আন্দোলনকারীদের দমনে পুলিশের ভূমিকা ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ।’
তবে পুলিশের এক পরিদর্শক এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মঙ্গলবার দুপুরে প্রেস ক্লাবের সামনে দায়িত্ব পালনরত ওই পুলিশ কর্মকর্তা হরতালের দিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘সাত-আট বছরের এক শিশু আমাকে মারতে আসে। আমি কি তাকে গুলি করবো নাকি লাঠি দিয়ে পেটাবো বলেন। আমি তাকে কিছু না করলেও সে বারবারই আমার দিকে তেড়ে আসে। আমাদেরকে নানা কৌশলে এ ধরণের পরিণতি মোকাবেলা করতে হয়েছে।’
সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পুলিশ সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছে।’