যথাযুক্ত সম্মানের পাশাপাশি তাঁদের সার্বিক যত্ন নেওয়া মানবতা ও ঈমানের দাবি; বরং প্রবীণদের যথাযথ মূল্যায়ন করার মধ্যেই একটি সমাজের কল্যাণ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রবীণদের সঙ্গেই তোমাদের কল্যাণ, বরকত আছে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৫৫৯; মুসতাদরাক হাকিম, হাদিস : ২১০)
তাই প্রবীণ যে-ই হোক না কেন তাঁকে সর্বাবস্থায় সম্মানের চোখে দেখতে হবে। উপযুক্ত পানাহার, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, যথাযোগ্য পোশাক ও মানসম্মত আবাসনের ব্যবস্থা করে তাঁদের কাছ থেকে দোয়া নিতে হবে।
বেশি বয়সীদের বিশেষ মর্যাদা : রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তির সংবাদ দেব না? তারা বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল (সা.)! তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যে দীর্ঘ আয়ু লাভ করে এবং সুন্দর আমল করে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৭২১২)
রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই শুভ্র চুলবিশিষ্ট মুসলিমকে সম্মান করা আল্লাহকে সম্মান করার শামিল।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৪৩)
প্রবীণ মাতা-পিতার প্রতি করণীয় : মহান আল্লাহ মাতা-পিতার প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আর তোমার রব আদেশ করেছেন যে তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো উপাসনা কোরো না এবং তোমরা মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তুমি তাদের প্রতি উহ শব্দটিও কোরো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না। আর তাদের সঙ্গে নরমভাবে কথা বলো। আর তাদের প্রতি মমতাবশে নম্রতার ডানা বিছিয়ে দাও এবং বলো, হে আমার রব, তুমি তাদের প্রতি দয়া করো যেমন তারা আমাকে ছোটকালে দয়াবশে প্রতিপালন করেছিলেন।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৩-২৪)
সালামে অগ্রাধিকার : রাসুল (সা.) বলেন, ‘ছোটরা বড়দের, চলমান ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে এবং কমসংখ্যক বেশিসংখ্যককে সালাম দেবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬২৩১)
সালাত আদায়ে বিশেষ সুবিধা : দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে অক্ষম প্রবীণ ব্যক্তিদের সুবিধাজনকভাবে সালাত আদায়ের অনুমতি দিয়েছে ইসলাম। ইমরান বিন হুসাইন (রা.) বলেন, আমি অর্শ্ব রোগে ভুগছিলাম। এ অবস্থায় রাসুল (সা.)-কে সালাত আদায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন, দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করো। যদি অক্ষম হও তবে বসে পড়ো। যদি তাতেও অক্ষম হও তাহলে শুয়ে শুয়ে পড়ো।’ (বুখারি, হাদিস : ১১১৭)
এমনকি প্রবীণদের সম্মানে রাসুল (সা.) সালাত সংক্ষিপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আবু মাসউদ (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আল্লাহর কসম! আমি অমুকের কারণে ফজরের সালাতে অনুপস্থিত থাকি। তিনি সালাতকে খুব দীর্ঘ করেন। আবু মাসউদ (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে উপদেশ দিতে গিয়ে সেদিনের মতো এত অধিক রাগান্বিত হতে কখনো দেখিনি। অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে বিতাড়নকারী বা বিরক্তকারী আছে। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সালাতে ইমামতি করবে, সে যেন সংক্ষেপ করে। কেননা তাদের মধ্যে দুর্বল, বৃদ্ধ ও বিপদগ্রস্ত লোকও থাকে। (বুখারি, হাদিস : ৭০২)
ইমামতিতে অগ্রাধিকার : ইমাম হওয়ার দিক দিয়ে রাসুল (সা.) প্রবীণদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আবু মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের বলেন, আল্লাহর কিতাব কোরআন মাজিদের জ্ঞান যার সবচেয়ে বেশি এবং যে কোরআন তিলাওয়াত সুন্দরভাবে করতে পারে, সে-ই সালাতের জামাতে ইমামতি করবে। সুন্দর কিরাতের ব্যাপারে সবাই যদি সমান হয় তাহলে তাদের মধ্যে যে হিজরতে অগ্রগামী সে ইমামতি করবে। হিজরতের ব্যাপারেও সবাই যদি সমান হয় তাহলে তাদের মধ্যে যে বয়সে প্রবীণ সে-ই ইমামতি করবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৭৩)
রোজা রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা : অতি বৃদ্ধ বা প্রবীণ ব্যক্তি রোজা পালনে অক্ষম হলে প্রতিদিনের রোজার বিনিময়ে একজন করে মিসকিনকে খাদ্য খাওয়াবে। আতা (রহ.) বলেন, আমি ইবনে আব্বাস (রা.)-কে পাঠ করতে শুনেছি যে ‘আর যাদের জন্য এটি (সিয়াম পালন) খুব কষ্টকর হবে, তারা যেন এর পরিবর্তে একজন করে অভাবীকে খাদ্য দান করে।’ এর ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, সিয়াম পালনে অক্ষম বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রত্যেক দিনের (প্রতিটি সিয়ামের) পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য খাওয়ানোর বিধানসংবলিত এই আয়াত রহিত হয়নি। (বুখারি, হাদিস : ৪৫০৫)
হজে বিশেষ সুযোগ : অক্ষম প্রবীণ বা বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষ থেকে সক্ষম ব্যক্তির মাধ্যমে হজ করানো ইসলামে বৈধ। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘বিদায় হজের বছর খাসআম গোত্রের একজন নারী এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওপর যে হজ ফরজ হয়েছে তা আমার বৃদ্ধ পিতার ওপর এমন সময় ফরজ হয়েছে যখন তিনি সওয়ারির ওপর ঠিকভাবে বসে থাকতে পারেন না। আমি তার পক্ষ থেকে হজ করলে তার হজ আদায় হবে কি? তিনি বলেন, হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ১৮৫৪)
রাসুল (সা.)-এর নৈকট্যে অগ্রাধিকার : রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যকার প্রবীণ ও জ্ঞানী লোকেরা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়। তারপর পর্যায়ক্রমে দাঁড়াবে যারা তাদের কাছাকাছি, তারপর দাঁড়াবে যারা তাদের কাছাকাছি তারা।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪৩২)
কথা বলায় অগ্রাধিকার : একবার আবদুল্লাহ ইবনে সাহল ও মুহাইয়াসা খাদ্যের অভাবে খায়বারে আসেন। ঘটনাক্রমে আবদুল্লাহ নিহত হলে রাসুল (সা.)-এর কাছে ঘটনাটি বলার জন্য মুহাইয়াসা অগ্রসর হয়। তখন রাসুল (সা.) মুহাইয়াসাকে বলেন, ‘বড়কে কথা বলতে দাও বড়কে কথা বলতে দাও। তিনি এতে বয়সে প্রবীণ ব্যক্তির কথা বলার অগ্রাধিকারের কথা বলেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৭১৯২)