৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ভোটের দিন আজ। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের নজর এই নির্বাচনের দিকে। কারণ বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে আজ নির্বাচিত করবেন মার্কিনিরা। হোয়াইট হাউজ দখলের এই লড়াইয়ের মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ছেন ৬ প্রার্থী
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছে গত ২৩৪ বছর ধরে। দেশটিতে মূলত রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রভাব। এ দুই দলের প্রার্থীরাই ঘুরেফিরে প্রেসিডেন্ট হন। রিপাবলিকান দলের এবারের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস। অবশ্য ছোট ছোট কিছু রাজনৈতিক দল যেমন লিবার্টারিয়ান, গ্রিন, ইনডিপেনডেন্ট পার্টি প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী দিয়েছে।
এবার ভোটে গ্রিন পার্টির প্রার্থী ৭৪ বছর বয়সী জিল স্টেইন এর আগে ২০১২ ও ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েছিলেন। ওই সময় তিনি দশমিক ৪ শতাংশ ও ১ শতাংশ করে ভোট পেয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন যেভাবে
নিউ ইয়র্কের ব্যালট পেপারে বাংলা ভাষা
লিবার্টারিয়ান পার্টির প্রার্থী হয়েছেন লিবার্টারিয়ান পার্টির চেজ অলিভার, যিনি ২০২০ সালের নির্বাচনে ১ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পেয়েছিলেন। এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের প্রায় সবকটিতেই লড়ছেন চেজ অলিভার। তাকে এবারের নির্বাচনের সম্ভাব্য অঘটন সৃষ্টিকারী ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
আরেক আলোচিত প্রার্থী হচ্ছেন রবার্ট জুনিয়র কেনেডি। তার পক্ষে এবারের নির্বাচনে ৫-৭ শতাংশ সমর্থন ছিল। কিন্তু গত আগস্ট মাসে তিনি ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তবে কয়েকটি অঙ্গরাজ্য তার নাম ব্যালট থেকে সরাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
আরেক প্রার্থী হচ্ছেন কর্নেল ওয়েস্ট। গ্রিন পার্টি থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন তিনি। বর্ণবাদবিরোধী ৭১ বছর বয়সী এ শিক্ষাবিদ বাইডেনকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ ও ট্রাম্পকে ‘নব্য ফ্যাসিস্ট’ বলে মনে করেন। তিনি ১২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে লড়ছেন। তার সমর্থন অল্প হলেও ডেমোক্র্যাট শিবিরের জন্য তিনি বড় দুশ্চিন্তার নাম।
দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হতে লড়ছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করেন। পপুলার ভোট (নাগরিকদের ভোট) কম পেয়েও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হন তিনি।
২০২০ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে সেবার ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে হেরে যান। আর এ বছরের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস।
ট্রাম্প যেখানে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য লড়াই করছেন, সেখানে কমলা হ্যারিস লড়াই করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার লক্ষ্যে।
কে এগিয়ে-কে পিছিয়ে
আল জাজিরার খবর অনুযায়ী, ডেটা অ্যানালিস্ট প্রতিষ্ঠান ফাইভথার্টিএইটের গতকাল সোমবারের সর্বশেষ জাতীয় জরিপের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের চেয়ে ১ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন হ্যারিস। ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ৪৭ দশমিক ৯ ও রিপাবলিকান প্রার্থী ৪৬ দশমিক ৯ পয়েন্ট জনসমর্থন পেয়েছেন।
এসব জরিপে পপুলার ভোটের ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হতে পপুলার ভোট নয়, বরং ২৭০টি ইলেক্ট্রোরাল ভোট লাগে। গত ছয়টি নির্বাচনের মধ্যে চারটিতেই বেশি পপুলার ভোট পেয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা। কিন্তু ইলেকটোরাল পদ্ধতির কারণে দুইবার জয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী।
যুক্তরাষ্ট্রে মোট ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ৫৩৮টি। ওয়াশিংটন ডিসির তিন জনসহ ৪৩৮ জন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ (নিম্নকক্ষ) এবং ১০০ জন সিনেটর (উচ্চকক্ষ) মিলে ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গণনা করা হয়। মেইন ও নেব্রাস্কা রাজ্য ছাড়া ৪৮টি রাজ্য ও ওয়াশিংটন ডিসিতে যিনি যে রাজ্যে সর্বোচ্চ পপুলার ভোট পাবেন তিনি ওই রাজ্যের সবগুলো ইলেকটোরাল ভোট পাবেন। নেব্রাস্কা ও মেইন রাজ্যের পপুলার ভোটের বিজয়ীরা পান দুটি করে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট।
ইলেকটোরাল ভোটের হিসাব আটকে রয়েছে সুইং রাজ্যগুলোতে। সাতটি সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব অঙ্গরাজ্য হলো পেনসিলভানিয়া (১৯ ইলেকটোরাল ভোট), নর্থ ক্যারোলাইনা (১৬), জর্জিয়া (১৬), মিশিগান (১৫), অ্যারিজোনা (১১), উইসকনসিন (১০) ও নেভাদা (৬)। দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে মোট ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ৯৩টি।
জরিপে বেশির ভাগ সুইং রাজ্যে হ্যারিসের চেয়ে এগিয়ে ট্রাম্প। তবে ব্যবধান কম। তাই শেষ মুহূর্তে তাই জয় নির্ধারণী সুইং বা দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে দৌড়ঝাঁপ করেছেন ট্রাম্প ও হ্যারিস। প্রেসিডেন্ট হতে হলে অবশ্যই বেশিরভাগ সুইং রাজ্যে জয় পেতে হবে ট্রাম্প কিংবা হ্যারিসকে।
ভোট গ্রহণ কখন শুরু, কখন শেষ
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকাল ৭টা (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৬টা) থেকে শুরু হবে ভোটগ্রহণ। রাজ্যভেদে ভোট গ্রহণের সময়সীমা হেরফের হবে। একইভাবে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার সময় হবে পৃথক। কখনো তা কাউন্টি ভেদেও হবে ভিন্ন। অধিকাংশ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ হবে ইস্টার্ন টাইম সন্ধ্যা ৬টা ও মিডনাইট ইস্টার্ন টাইমের (২২: ০০-০৪: ০০ জিএমটি) মধ্যে।
এদিকে ভোটকেন্দ্র প্রথম বন্ধ হওয়ার (ইস্টার্ন টাইম সন্ধ্যা ৬টা) সঙ্গে সঙ্গে ভোট গণনার কাজ শুরু হবে। এর কয়েক ঘণ্টা পর থেকে ফলাফল আসতে শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এবারের নির্বাচনে ১৮ কোটির বেশি নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ইতিমধ্যে ৭ কোটি ৮০ লাখের বেশি আগাম ভোট পড়েছে। বাকিরা আজ সশরীরে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেবেন। বিপুল মানুষ ডাকযোগে ভোট দেওয়ায় এবারের নির্বাচনের ফল পেতে দেরি হতে পারে। এ কারণে বড় ধরনের উত্তেজনা তৈরির আশঙ্কা রয়ে গেছে।
ডাকযোগে ভোট কখন ও কীভাবে গণনা করা হবে তার জন্য একেক রাজ্যে রয়েছে একেক ধরনের আইন। কিছু কিছু রাজ্যে, যেমন ফ্লোরিডা এবং অ্যারিজোনা, সেখানে ডাকযোগে ভোটের গণনা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু উইসকনসিন ও পেনসিলভানিয়ায় ৫ নভেম্বরের আগে সেগুলো স্পর্শ করা হবে না। ফলে সেখান থেকে ভোটের ফলাফল দেরিতে আসবে। নর্থ ক্যারোলাইনায় ভোটগ্রহণ শেষ হবে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। ফ্লোরিডাতে ভোটগ্রহণ শেষ হবে স্থানীয় সময় রাত ৮টায়।
অনেক অঙ্গরাজ্যে ভোট গণনার নিয়মে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। অন্যদিকে আবার মিশিগানের মতো অঙ্গরাজ্যে গণনা দ্রুত হবে। কারণ, সেখানে ডাকযোগে আসা ভোট কমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার নিজ নিজ আইন অনুযায়ী ভোট দেওয়ার সময়সীমা ঘোষণা করা আছে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ব্যালট গণনা ও কখন চিঠির মাধ্যমে আসা ভোট গ্রহণ করা যাবে, সে সংক্রান্ত আলাদা আলাদা আইন রয়েছে। এ কারণে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের চূড়ান্ত ফলাফল নির্বাচনের পরের দিন বা তারও পরে জানা যাবে।
২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করতে বেশ কয়েক দিন লেগে গিয়েছিল। এবারও এমন হতে পারে যে নতুন প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে বিজয়ীদের নাম জানতে ৫ নভেম্বরের বেশ কয়েকদিন পর পর্যন্ত অপেক্ষার প্রয়োজন দেখা দেবে।
জাতীয় ও দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে ট্রাম্প ও হ্যারিসের মধ্যে যে তীব্র প্রতিযোগিতার আভাস দেওয়া হয়েছে তাতে জয়ের ব্যবধান হতে পারে খুব অল্প ভোটে। অনেক ক্ষেত্রে ভোট পুনর্গণনার দাবিও আসতে পারে।
ভোট গণনা পদ্ধতি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যে ভোটের পদ্ধতির নির্দিষ্ট বিধি রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তা পরস্পরের থেকে আলাদা। তিনটি প্রাথমিক পদ্ধতির মাধ্যমে ভোট দেন। এগুলো হচ্ছে হ্যান্ডমার্ক করা কাগজের ব্যালট, ব্যালট মার্কিং ডিভাইস (বিএমডি) ও ডাইরেক্ট রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক (ডিআরই)। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত এবং সহজ পদ্ধতি কাগজের ব্যালট, প্রায় ৭০ শতাংশ কাগজের ব্যালট ব্যবহার করেন। ২৫ শতাংশেরও বেশি ভোটার ব্যবহার করেন এই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ভোটদান পদ্ধতি বিএমডি। ভোটারদের একটি স্ক্রিনে বিকল্প নির্বাচন করতে দেয় এবং তারপর তাঁদের পছন্দ নিশ্চিত করতে একটি কাগজের ব্যালট প্রিন্ট করা হয় এই ব্যবস্থায়। ডিআরই যন্ত্রনির্ভর পদ্ধতি অনেকটা ইভিএমের মতোই।
যুক্তরাষ্ট্রের ভোট গণনার পদ্ধতিতেও কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। ভোটের দিন যে ভোট পড়ে তা প্রথমে গণনা করা হয়। এরপর আগাম ও ডাকযোগে আসা ভোট গণনা করা হয়। এরপর অভিবাসী ও সামরিক ভোটও গণনায় আনা হয়। স্থানীয় নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোট যাচাই, প্রক্রিয়াকরণ ও গণনার সঙ্গে যুক্ত থাকেন।
হাতে চিহ্নিত কাগজের ব্যালট এবং বিএমডিতে দেওয়া ভোটগুলো সাধারণত ‘অপটিক্যাল স্ক্যানার’ ব্যবহার করে স্ক্যান করা হয়। এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফলাফল নথিভুক্ত করা যায়। এই প্রক্রিয়াটি একটি রাজ্য-স্তরের নির্বাচন কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করেন। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণনার পাশাপাশি প্রয়োজনে হাতে ভোট গণনারও ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া আগাম ভোটের ক্ষেত্রে চালু ‘মেইল ইন ব্যালট’ ব্যবস্থায় দেওয়া ভোটের বৈধতা যাচাই এবং গণনার প্রক্রিয়াও রয়েছে কয়েকটি প্রদেশে। রাজ্য নির্বাচন কর্তৃপক্ষকে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে ফলাফল ফেডারেল কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করতে হয়।
কংগ্রেসের নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ
আজ প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পাশাপাশি ৩৪ জন সিনেটর এবং কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সবাইকে বেছে নেবেন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা। এছাড়া ৫০ অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ১১টিতে নতুন গভর্নর পদে নির্বাচন হবে। সব মিলিয়ে এ বছর পাঁচ হাজারেরও বেশি স্থানীয়, অঙ্গরাজ্য পর্যায়ের ও কেন্দ্রীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
এসব নির্বাচনের পাশাপাশি অনেক অঙ্গরাজ্যে রেফারেন্ডাম নামেও এক ধরনের ভোট হতে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যালটের মাধ্যমে গর্ভপাত আইন থেকে শুরু করে কর নীতিমালা, মারিজুয়ানার ব্যবহারসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে ভোটাররা সিদ্ধান্ত নেন।