সংসদীয় নির্বাচনের ভোট গণনা শেষে আজ ফলাফল ঘোষণা হবে। সাত দফায় প্রায় আড়াই মাস ধরে ভোটগ্রহণ শেষে আজ সকাল ৮টা থেকেই গণনা শুরু হবে ৫৪২টি লোকসভা আসনে। বিরোধী প্রার্থী না থাকায় গুজরাটের সুরাত লোকসভা আসনে ভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেছেন বিজেপির প্রার্থী। গণনার গতিপ্রকৃতি মেনে বিকালের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে ক্ষমতায় আসছে কোন জোট। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বেই তৃতীয়বার বিজেপির জোট এনডিএ ক্ষমতায় ফিরছে নাকি কংগ্রেসের জোট ‘ইন্ডিয়া’র ভাগ্য ফিরবে- সেটাই স্পষ্ট হবে।
অবশ্য ভারতের বিভিন্ন সংস্থার এক্সিট পোল জানিয়েছে, তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরছে মোদি সরকার। যদিও সোমবারই দিল্লিতে কংগ্রেসের সাবেক সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী পালটা দাবি করেছেন, ‘এক্সিট পোল যা দাবি করছে, ঠিক এর উলটো হবে, ক্ষমতায় আসছে ইন্ডিয়া জোট।’ তবে নির্বাচনি প্রচারে নেমে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তোলা ‘৪০০ পার’ স্লোগান ছোঁয়া সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে বিজেপির শীর্ষ মহলেও জোর চর্চা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের ফল ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের চেয়েও খারাপ হবে বলে বিভিন্ন এক্সিট পোলে ইঙ্গিত মিলেছে। দাবি করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে বিজেপি একাই ২৪-২৮টি আসন পেতে পারে। মমতা ব্যানার্জির দল তৃণমূল কংগ্রেস ১৪ থেকে ১৮টি পেতে পারে, বাম-কংগ্রেস জোট ১-৩টি আসন পেতে পারে বলে দাবি সমীক্ষায়। যদিও মমতা স্বয়ং দাবি করেছেন, সমীক্ষার দাবি ভুল প্রমাণ করে তৃণমূল একাই ৩০-৩৪টি আসন পাবে। পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের জন্য ৫৫টি কেন্দ্রে ভোট গণনা শুরু হবে সকাল ৮টা থেকে।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারিতে গণনা চলবে, সরাসরি নজর রাখবে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনও। ভোট গণনায় কোনো ত্রুটি হবে না, লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগের দিন সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে আশ্বাস দিলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার। আমরা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী যে, ভোট ও ফল-পরবর্তী হিংসা দেখতে পাব না। তিনি বলেন, গণনা প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছি। আপনারা জানেন, গণনার সময় ও গণনাকেন্দ্রে কয়েক লাখ লোক উপস্থিত থাকবেন। তাও আমাদের প্রক্রিয়া অত্যন্ত বলিষ্ঠ, এই আশ্বাস দিতে পারি সবাইকে।
রাজীব কুমার আরও বলেন, এবার ৩১ কোটির বেশি নারী ভোট দিয়েছেন। ৬৪ কোটি ভোট পড়েছে। মজা করে তিনি বলেন, লাপতা ভদ্রলোকরা এবার বুথমুখী হয়েছেন। সামগ্রিকভাবে ভোটের ফল ঘোষণার আগের তিন নির্বাচন কমিশনার পাশাপাশি বসে জানিয়ে দিলেন সার্থকভাবে এ ভোটপর্ব মিটেছে। শায়েরি করেও রাজীব বলেন, ফুলের সৌন্দর্য সবাই মনে রাখে, প্রশংসা করে। কিন্তু মালির খোঁজ কে রাখে?
লোকসভা ভোটের প্রচারে নেমে বিভিন্ন নির্বাচনি জনসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হুংকার দিয়েছিলেন, ‘ভোটে জিতেই পাক অধিকৃত কাশ্মীর উদ্ধার করা হবে। পাশাপাশি ভারতে সন্ত্রাসের বিষ ছড়ালে যোগ্য জবাব দেওয়া হবে পাকিস্তানকে।’ স্বভাবতই ভারতের ভোটের ফলাফলের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে পাকিস্তানেরও। এমনই জটিল প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশের নির্বাচনি ফল প্রকাশের দিন আজই চীন সফরে যাচ্ছেন পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ।
ভারতের কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লোকসভা নির্বাচন-উত্তর মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের মোকাবিলা করতে ‘বন্ধু’ চীনের শরণাপন্ন হচ্ছেন পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। তাই ভারতের নির্বাচনি ফলাফলের দিনই চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন শাহবাজ। এই আবহে ভারতকে বিপাকে ফেলতে নতুন কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে পারে দুদেশ। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে পাকিস্তানে পরিকাঠামো নির্মাণে উদ্যোগী হয়ে ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ প্রকল্প শুরু করে চীন। ওই প্রকল্পের অন্তর্গত একটি সড়ক গিয়েছে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে। আর তাতেই ঘোর আপত্তি ভারতের। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং থেকে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর- বারবার চীনের এই ‘বিতর্কিত’ প্রকল্প নিয়ে হুঁশিয়ারির সুর শোনা গিয়েছে তাদের গলায়। ‘শত্রু’ দেশের কাছ থেকে পাক অধিকৃত কাশ্মীর ছিনিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর দিল্লি। এছাড়া ভারতে ভোট শুরু হওয়ার আগেই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং হুংকার দিয়েছিলেন, ‘দেশকে অশান্ত করতে এলে ঘরে ঢুকে মারব। সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানে গিয়েও পার পাবে না।’
ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস বলছে, নির্বাচনে বুথফেরত সমীক্ষার ইঙ্গিত যে সব সময় মেলে, এমন নয়, উলটোও হয়। ২০০৫ সালে ‘ইন্ডিয়া শাইনিং বলে অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসছে বলা হলেও ফল হয়েছিল বিপরীত। মনমোহন সিংয়ের সরকার জিতেছিল। আবার বুথফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস মিলে যাওয়ার বহু উদাহরণও রয়েছে। অনেকে মনে করেন, এ ধরনের সমীক্ষায় মোটের ওপর ভোটারের মনের একটি আভাস পাওয়া যায়। তবে ঘটনাচক্রে ২০১৪ ও ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের মতোই এবারও ভারতের অধিকাংশ বুথফেরত সমীক্ষাই বলছে, ফের দিল্লিতে সরকার গড়তে চলেছে মোদির নেতৃত্বে এনডিএ জোট।
বুথফেরত সমীক্ষাতেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে জমি ধরে রাখার পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতেও অগ্রগতি হতে পারে বিজেপির। এমনকি এক বছর আগে জেতা কর্ণাটক এবং ছয় মাস আগে জেতা তেলঙ্গানায়ও জনসমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হতে পারে কংগ্রেস। এই প্রথম কেরলে একা লড়ে বিজেপি আসন জিততে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে অধিকাংশ সমীক্ষায়। পড়শি রাজ্য তামিলনাড়ুতে দুই বৃহৎ দল ডিএমকে ও এডিএমকের সাহায্য ছাড়াই মোদি একাধিক আসনে জিততে পারেন বলে দাবি।
পঞ্জাবে প্রথমবার লোকসভা ভোটে একার জোরে লড়তে নেমেও চমকে দিতে পারে বিজেপি, এমনই দাবি এক্সিট পোলে। তবে এবিপি নিউজ-সি ভোটার বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের ৪০০ আসনে জেতার পূর্বাভাস না দিলেও ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া এবং নিউজ ২৪-টুডেজ চাণক্যের বুথফেরত সমীক্ষায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটকে ‘৪০০ পার’ স্বপ্নপূরণের বার্তা দিয়েছে। এবিপি নিউজ-সি ভোটারের পূর্বাভাস, এনডিএ ৩৫৩-৩৮৩, ‘ইন্ডিয়া’ ১৫২-১৮২ এবং অন্যরা ৪-১২টি লোকসভা আসনে জিততে পারে।