শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৮ পূর্বাহ্ন

‘আরসা’ ভয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারী, ২০২৩

ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ক9ক্সবাজারের উখিয়ার জামতলার ১৫ নম্বর ক্যাম্পে থাকেন রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) আবদুল বাসের। ক্যাম্পে বাসেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আরেক মাঝি আহমদ রশিদ। ৭২ ঘণ্টা আগে শনিবার খুন হন রশিদ। এর পর থেকে ভয়ে আছেন বাসের। তবে গতকাল সোমবার বিকেল থেকে তাঁর মোবাইলে ফোন করে দেওয়া হচ্ছে হত্যার হুমকি। এর পর থেকে বাসেরের ‘ঘরবন্দি’ জীবন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন ভয়ের রাজ্য। বিশেষ করে বিভিন্ন ক্যাম্পের এক হাজার মাঝি তাঁদের জীবন নিয়ে রয়েছেন শঙ্কায়। একের পর এক খুনোখুনিতে অনেকে চলে গেছেন আত্মগোপনে।

রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, মিয়ানমারভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এখন আরও বেপরোয়া। তারা জড়াচ্ছে একের পর এক হত্যায়। নতুন করে মিলছে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গ্রেনেড। তুমব্রুর শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের গোপন আস্তানা। হত্যার ঘটনার পরই শূন্যরেখার ক্যাম্পে তারা পালিয়ে যায়। এ কারণে অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে গত শুক্রবার উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প-৮ থেকে গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় মোহাম্মদ নবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কক্সবাজারের ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি আমির জাফর সমকালকে বলেন, গ্রেনেডটি দেশের বাইরের মনে হচ্ছে। তবে এতে কোনো দেশের নাম লেখা নেই। গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে। গ্রেনেডটি কারা কেন এনেছে, তা নিয়ে চলছে তদন্ত। হঠাৎ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে যুদ্ধ চলছে। আরও অনেক বিষয় আছে। তবে ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা তৎপর।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো, মাহফুজুল ইসলাম বলেন, যার বাসায় গ্রেনেডটি পাওয়া গেছে তাকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। যার বাসায় গ্রেনেড, তিনি জানবেন না- এটা হতে পারে না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, গত চার মাসে ক্যাম্পে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজন আরসা সদস্য ও আটজন রোহিঙ্গা মাঝি। বাকিরা সাধারণ রোহিঙ্গা। ক্যাম্পে আরসা ছাড়াও আরএসও, ইসলামী মাহাজ, নবী হোসেন ও মুন্না গ্রুপ সক্রিয়। এ ছাড়া সম্প্রতি ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গ্রেনেড মিলছে। একের পর এক অপহরণের ঘটনাও ঘটছে।

হত্যার হুমকি পাওয়া মাঝি আবদুল বাসের সমকালকে জানান, আরসা নেতা সালিহ উদ্দিন পরিচয়ে তাঁকে ফোনে হুমকি দেওয়া হয়। ফোনের ওপাশ থেকে বলা হয়- ‘কিছু খাওয়ার থাকলে শেষবারের মতো খেয়ে নে। সময় বেশি নেই। আরসাকে সহযোগিতা করতে হবে। নইলে প্রাণ যাবে। পুলিশকে কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না।’
বাসের জানান, রোহিঙ্গা মাঝিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন ক্যাম্পে। প্রাণভয়ে একত্র হয়ে চলাফেরা করছেন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরও একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প আরসার সদস্য হিসেবে পরিচয়ধারীরা একক নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য, সালিশ-বৈঠক, মাদক কারবার ও চোরচালানে তারা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতে চাইছে না। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঝিরা স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করে আসছেন। ক্যাম্পের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আগাম তথ্য তাঁরা প্রশাসনকে জানান। এ কারণে মাঝিদের ‘পথের কাঁটা’ মনে করছে আরসা পরিচয়ধারীরা।
আরসা পরিচয়ে যারা ক্যাম্প দাপাচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে বড় সেলিম, সাবের, মৌলভি আতাউল্লাহ, ইছমাইল, মো, নূর, মামুনুর রশিদ, জোবায়ের ও সেলিম।

নাম প্রকাশে ভীত আরও দুই মাঝি জানান, আগে ক্যাম্পে দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যেত। সম্প্রতি খুনোখুনিতে পিস্তল, শটগান ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার কোনো ঘটনার আগে শূনরেখায় গোপন বৈঠক করা হয়। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আরসা সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পে এসে হামলা চালিয়ে আবার পালিয়ে যায়।
ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, খুনোখুনির পাশাপাশি অপহরণও চলছে সমানতালে। সবশেষ রোববার টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকায় ক্ষেত পাহারারত চার কৃষককে অপহরণ করা হয়। পরে চার কৃষক পরিবারের কাছে দাবি করা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ। এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা এলাকার একটি খালে মাছ ধরতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন আট ব্যক্তি। মুক্তিপণ দিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন। একইভাবে গত ২৯ সেপ্টেম্বর একই উপজেলার পানখালী ও মরিচ্যাঘোনার পাহাড়ি এলাকা থেকে পাঁচ কৃষককে অপহরণ করা হয়।

পুলিশের তথ্য বলছে, গত আট দিনে চার হত্যাকাণ্ডসহ আটজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহত সবাই মাঝির দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া গত বছরের শেষ চার মাসে ২৪ জন খুন হন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নতুন করে ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে আরসা গোপন বৈঠকে বসেছিল ৪ জানুয়ারি। উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে পাহাড়ি এলাকায় সংগঠনের সেকেন্ড ইন কমান্ড ওস্তাদ খালেদের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি গ্রুপের বৈঠক হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়- যেসব মাঝি ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না, কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন; তাঁদের হত্যা করা হবে। বিষয়টি তাঁদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে জানিয়ে দেওয়া হয়। বৈঠকে লাল মোহাম্মদ ওরফে বোরহান ছাড়া ছমি উদ্দিন, মৌলভী আকিজ উদ্দিন, মাস্টার আলী জোহার, ডাক্তার ওয়াক্কাস, মো. করিম ওরফে ডাকাত করিম, আবদুর রহিম, মুফতি জামাল, নবী হোসেন, ছলিম উল্লাহ ওরফে ইয়াবা ছলিমসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এরই অংশ হিসেবে গত শনিবার কক্সবাজারের পালংখালীর জামতলী শরণার্থী শিবিরে (১৫ নম্বর ক্যাম্প) রোহিঙ্গা নেতা (হেড মাঝি) রশিদ আহমদকে ঘরে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে মুখোশধারী দুস্কৃতকারীরা। এর আগের দিন রাত সাড়ে ৩টার দিকে বালুখালীর ৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি-ব্লকের সাব-মাঝি মোহাম্মদ সেলিমকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে এক দল অস্ত্রধারী।

এদিকে ক্যাম্পে আরসার গোপন বৈঠকে মাঝিদের কিলিং মিশনের কথা ফাঁস হয়ে গেলে অনেক মাঝি আত্মগোপনে চলে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের এক হেড মাঝি জানান, ‘হঠাৎ ক্যাম্পে মাঝিদের টার্গেট করে খুন করা হচ্ছে। এতে অনেকে গোপনে চলে গেছেন। অনেকে ভয়ে রাতে বাড়িতে থাকছেন না।’

উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের এক মাঝি বলেন, আমরা সবসময় চাই ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা। অনেক সময় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে আমরা বাধা দিই। আমাদের কারণে তারা আগের মতো মাদক-মানব পাচারসহ চাঁদাবাজি করতে পারছে না। ফলে তাদের আর্থিক নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে গেছে। এ কারণে তারা আবার হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে।

উখিয়ার ৫, ৭, ৮, ৯, ১০, ১৭ ও ২০ নম্বর ক্যাম্পে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা অস্ত্রধারী সক্রিয়। এসব ক্যাম্প পাহাড়ে এবং যাতায়াত ব্যবস্থা কঠিন হওয়ার কারণে তারা সেখানে আবাস গড়ে তোলে। ফলে ক্যাম্পে অভিযান জোরদার হলে তারা কাছের পাহাড়ি ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নেয়। উখিয়ার রোহিঙ্গা নেতা মো. রফিক বলেন, ‘ঘনবসতি হওয়ায় অপরাধীরা ক্যাম্প-সংলগ্ন পাহাড়ে তাদের গোপন আস্তানা তৈরি করছে। শুধু ক্যাম্পে নয়; মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায়ও তারা আস্তানা গেড়েছে। এ কারণে অনেক সময় ক্যাম্প থেকে পালিয়ে সীমান্তে অবস্থান করেন। তিনি বলেন, ‘মাসখানেক আগে অস্ত্রধারী ২০ জনের একটি দল তাঁর ক্যাম্পে ৩০০ রাউন্ড গুলি চালিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়। এ সময় একে-৪৭, শটগান, পিস্তলসহ দেশীয় বন্দুক তাদের হাতে দেখা গেছে। এভাবে এর আগেও তারা দুটি ক্যাম্পে গুলি করে ভয়ভীতি দেখায়।’

পুলিশ ও এপিবিএন জানায়, গত এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০টি দেশীয় অস্ত্র, দুটি বিদেশি পিস্তল, কয়েকশ রাউন্ড গুলি, ১৪ ভরি স্বর্ণ, ১৭ লাখ ইয়াবা, জাল নোটসহ অবৈধ অনেক কিছু জব্দ করা হয়। তবে গত শুক্রবার উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প-৮ এ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মোহাম্মদ নবীর বাসা থেকে একটি গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় নতুন করে ক্যাম্পে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। গ্রেনেডটি আসলে আহত নবীর ওপরে ছুড়ে মারা হয়েছে; নাকি তিনি নিজেই এটি এনে বাড়িতে রেখেছেন- এখনও নিশ্চিত নয়। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বালুখালী, ওলাকালং ও শূন্যরেখা দিয়েও ক্যাম্পে অস্ত্রসহ অবৈধ মালপত্র ঢুকছে।

জানা গেছে, শূন্যরেখাকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাম্পে অভিযান জোরদার করলেও অস্ত্রধারীরা শূন্যরেখায় আশ্রয় নেয়। পরে অভিযান থেমে গেলে আবার ক্যাম্পে ফেরে। রোহিঙ্গা নেতারা জানান, আরসা গত বছর ক্যাম্পের এইচ-৫২ ব্লকের একটি মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে ছয় রোহিঙ্গাকে হত্যা করে।

৮-এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (অপস অ্যান্ড মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ বলেন, শিবিরগুলোতে অপরাধীদের নির্মূল করতে অভিযান চলছে।

এইচ বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর এ আপনাকে স্বাগতম। “সময়ের প্রয়োজনে- HBD NEWS24” নিয়ে আমরা আছি আপনার পাশে। আপনার পাশে ঘটে যাওয়া নানা সংগতি, অসংগতি আর তথ্য নিয়ে আপনিও যোগ দিন HBD NEWS 24 এ আমাদের কাছে মেইল করুন: hbdnews24@yahoo.com

More News Of This Category

© All rights reserved © 2012 HBDNEWS24

POWERED BY MH GROUP OF COMPANY.