পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ভাষা। খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে এই ভাষার উদ্ভব হয়। উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসের সঙ্গে ফারসি ভাষার নিগূঢ়তম সম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ শ বছর ফারসি ভাষা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপরও রয়েছে ফারসি ভাষার সুদীর্ঘ প্রভাব।
ফারসি ভাষার উদ্ভব : ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে ইরানে। আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে মধ্য এশিয়ার সমভূমি থেকে ইরানে অভিবাসন শুরু করলে ওই এলাকার আদিবাসী এবং আর্যদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও মেলামেশার ফলে ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতির উদ্ভব হয়। এ ভাষা চারটি পর্যায়ে বিকাশ লাভ করে—আবেস্তা, প্রাচীন ফারসি, পাহলভি ও আধুনিক ফারসি।
উত্তর ইরানের মিডিয়া এলাকায় আবেস্তা ভাষার উৎপত্তি। তবে লিখিত আকারে প্রকাশিত হওয়ার আগেই তা একটি মৃত ভাষায় পরিণত হয়। প্রাচীন ফারসি খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালের দিকে হাখামানশিদের যুগে ইরানে প্রচলিত ছিল। তবে ভাষাটি শুধু রাজকীয় নির্দেশাবলি প্রচারের কাজেই ব্যবহৃত হতো। কারণ স্বল্পসংখ্যক লোক এর পাঠ জানত। আশকানিযুগে (খ্রি.পূ ২৪৯-২২৬) পাহলভি বা মধ্য ফারসি নামে ইরানে আর একটি ভাষার উদ্ভব ঘটে। এটি মূলত আবেস্তা ও প্রাচীন ফারসির বিবর্তিত রূপ। প্রায় এক হাজার বছর এ ভাষা ইরানে প্রচলিত ছিল। মুসলমান কর্তৃক ইরান দখলের পর আরবি ভাষার প্রভাবে ফারসি ভাষার আধুনিক রূপ লাভ করে। আরব ভাষাবিদরা পাহলভি বর্ণমালাকে আরবি বর্ণমালার ধাঁচে পরিবর্তন করেন। (প্রবন্ধ : ফারসি, বাংলাপিডিয়া)
ফারসি ভাষার উন্নয়নে মুসলিম অবদান : ফারসি ভাষার আধুনিক কাঠামো দান, পারস্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষা এবং ফারসিকে আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা প্রদানে মুসলিম শাসকদের অসামান্য অবদান রয়েছে। ফারসি ভাষার উন্নয়নে সুলতান মাহমুদ গজনভি (রহ.)-এর অসামান্য অবদান রয়েছে। ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকাতে বলা হয়েছে, ‘ফারসি সাহিত্যের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রের নাম গাজনা, সুলতান মাহমুদ গজনভি (মৃত্যু ১০৩০)-এর দরবার। একজন কঠোর যোদ্ধা হওয়ার পরও প্রেমের কবিতার প্রতি মাহমুদের অনুরাগ ছিল। গজনির শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফারসি গীতিকবিতা ও মহাকাব্যের বিকাশ ঘটে। সুলতান মাহমুদের অর্থায়নে মহাকবি ফেরদৌসি ‘শাহনামা’ রচনা করেন। এ ছাড়াও ফারসি ভাষার যেসব কবি ও সাহিত্যিক আধুনিক বিশ্বে আলোচিত ও সমাদৃত তাদের প্রায় সবাই মুসলিম। যেমন ফেরদৌসি, ওমর খৈয়াম, ফরিদুদ্দিন আত্তার, নিজামুদ্দিন নিজামি, জালালুদ্দিন রুমি, শেখ সাদি, হাফেজ সিরাজি, সাইয়েদ মুহাম্মদ হুসাইন বাহজাত তাবরিজি প্রমুখ।
বিস্ময়কর বিষয় হলো, ফারসি ভাষার জন্ম ও বিকাশ পারস্য হলেও প্রথম ফারসি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে ভারতবর্ষে।
উপমহাদেশর সঙ্গে ফারসির সংযোগ : ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই পারস্য সভ্যতা ও ফারসি ভাষার সঙ্গে উপমহাদেশের সংযোগ স্থাপিত হয়। উভয় সভ্যতা পরস্পরের সংস্পর্শে আসে। ভারতের নৌবন্দরগুলো দেবল, নিরুন, সুপারাকা, বাড়িগাজা, টাগারা, মুজিরিস, নেলকিনডা, আরিয়েক, তাম্রলিপ্তি, গাঙ্গে, সাপ্তগ্রামা (সাতগাঁও/সপ্তগ্রাম), সরন্দিপ প্রভৃতি থেকে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের নৌযান পারস্য উপসাগরের উবুলা, ওমানা, ইউডেইমন, সিরফ, কাইস, হরমুজ, সকোট্রা এবং গেড্রসিয়া উপকূল অতিক্রম করত। ফলে উপমহাদেশের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্যের শুধু বাণিজ্যিক সম্পর্কই নয়, সাংস্কৃতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। পারসিক বণিক ও বাণিজ্যপণ্যের সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যবাহিনী, প্রকৌশলী, কারিগর, সুফি, দরবেশ এবং শিল্পীদেরও আগমন ঘটে। এ ধরনের সম্পর্ক পর্যায়ক্রমে রাজদরবার, সমাজ ও শিল্পসাহিত্য পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। (প্রবন্ধ : ফারসি, বাংলাপিডিয়া)
মুসলিম ভারতে ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতি : ৭১১ খ্রিস্টাব্দের মুহাম্মদ বিন কাসেমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে উপমহাদেশে মুসলিম জাতির জয়যাত্রা শুরু হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় সুলতান মুহাম্মদ ঘোরিকে। তিনি ১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে মুলতান জয় করেন। তার পরে খিলজি ও মোগলদের আগমন হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কর্তৃক ‘ইংরেজি শিক্ষা আইন ১৮৩৫’ প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত মুসলিম শাসনের সব পর্যায়ে উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল ফারসি। দীর্ঘ ৬৩৪ বছর রাজ ভাষা হিসেবে ফারসি ভারতীয় শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
আফগানিস্তানের পারওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের পারসিয়ান দারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মারিয়াম সাহেবি লেখেন, ‘ভারতে মোগল শাসনামলে ভারতীয় সংস্কৃতি ও শিক্ষা, সাহিত্য ও বিজ্ঞান, যা উভয় জাতির মধ্যে বিনিময় হয়েছিল তা ফারসি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এ সময় প্রায় সব ভারতীয় ভাষা ফারসি দ্বারা প্রভাবিত হয়। শুধু সাহিত্য নয়; বরং সাধারণ মানুষের ভাষাও প্রভাবিত হয়। ফারসি ভাষা ভারতের উর্দু, পাঞ্জাবি ও সিন্ধি ভাষাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ভারতের অন্যান্য ভাষা যেমন হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, রাজস্থানি ফারসি ভাষা থেকে বিপুলসংখ্যক শব্দ আত্মস্থ করে। মোগল শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় পারস্যের কবি ও পণ্ডিতরা ভারতীয় সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের স্পষ্টতই প্রভাবিত করে। দরবারের কর্মকর্তা ও অভিজাত ব্যক্তিরা পারস্যের পোশাক পরিধান করত, ফারসি ভাষায় কথা বলত এবং ফারসি কবিতা উপভোগ করত।’ (প্রবন্ধ : ইফেক্ট অব পারসিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ অন ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস)
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ফারসির প্রভাব : বাংলায় মুসলমানের আগমন ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। মুসলমানের আগমনের ফলে আরবি-ফার্সির অফুরন্ত শব্দভাণ্ডার ও তার প্রাসাদগুণে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ফারসির প্রভাব সম্পর্কে লেখেন, ‘মুসলমান আগমনের আগে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিলো। …হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন—জহুরির আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোনো শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেলো। তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন।