অতিবৃষ্টি, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জ্বালানির উচ্চমূল্যে ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে ব্যাহত হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালেও এসব কারণে খাদ্য ও শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে। যদিও সরবরাহ ঘাটতি ও পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে কৃষকরা আবাদ বাড়াতে উৎসাহী হচ্ছেন। কিন্তু গম ও চালের মতো আবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের যে পরিমাণ মজুদ প্রয়োজন, উৎপাদন বাড়লেও তা পূরণ হবে না, বিশেষ করে ২০২৩ সালের প্রথম ভাগে।
অথচ লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু এলাকায় এখনো খাদ্যশস্য ও ভোজ্য তেল উৎপাদনে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন কৃষকরা।
সিডনিভিত্তিক কৃষিপ্রতিষ্ঠান আইকন কমোডিটিজের পরামর্শক সেবা বিষয়ক পরিচালক ওয়েল হুই বলেন, ‘বর্তমানে খাদ্যপণ্যের যে চাহিদা তা পূরণে বিশ্বে রেকর্ড শস্য উৎপাদন করতে হবে। বিশেষ করে ২০২৩ সালে উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে আরো ভালো প্রয়োজন। কিন্তু আমরা বৈশ্বিক খাদ্যশস্য ও তেলবীজ উৎপাদনের যে পূর্বাভাস দেখছি তাতে এটি সম্ভব মনে হচ্ছে না। ’ তাঁর মতে, পূর্বভাসে দেখা যাচ্ছে যে গম, ভুট্টা ও পাম তেলের যে রেকর্ড উৎপাদন হয়েছিল এবার তা হবে না, ফলে সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকবে না। এতে ২০২৩ সালে মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
এ বছর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের রেকর্ড মূল্য বৃদ্ধি পায়। এতে বিশ্বজুড়ে কয়েক কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতায় পড়েছে। ২০২২ সালে খাদ্য আমদানি ব্যয় বেড়ে হয়েছে রেকর্ড প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার। এতে দরিদ্র দেশগুলো ভোগ কমাতে বাধ্য হয়েছে।
গত শুক্রবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সাল একটি অনিশ্চয়তার বছর। আগামী বছর এ অনিশ্চয়তা আরো বাড়বে। খাদ্য ও ঋণ সংকট আরো প্রকট হবে। পণ্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতির কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। পণ্যের সরবরাহব্যবস্থায় বড় বাধা এসেছে। এর পাশাপাশি ছিল অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। এসব কারণে করোনা মহামারি মোকাবেলা যেমন দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। তেমনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনৈতিক ও সামজিক ক্ষতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে আরো বাধাগ্রস্ত করেছে। সব কিছু ছাড়িয়ে এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
‘২০২২ সাল পর্যালোচনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ৯টি গ্রাফের মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী কয়েক বছরের পূর্বাভাসও দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ৭৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে না। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা প্রকট আকারে বেড়েছে। এর ফলে খাদ্যসংকটে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। আগামী বছর এ সংকট আরো বাড়তে পারে। ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের এখন থেকেই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্যান্য খাতে ব্যয় সাশ্রয় করতে হবে।
করোনা মহামারি মোকাবেলায় ২০২২ সালে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই গতিকে থামিয়ে দিয়ে আরো প্রকট সংকট সৃষ্টি করেছে, যা এখন বিশ্বকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় ও উন্নত দেশগুলো সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়ায় ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমে যাচ্ছে। এতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো বড় সংকটে পড়েছে। স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ তাদের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭০ সালের পর বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে মন্থর অবস্থায় রয়েছে। ভোক্তাদের আস্থা গত পাঁচ দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে ধীর হয়েছে। এর প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে পরের বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি মাঝারি আঘাত আসতে পারে, যা অর্থনীতিকে আরো মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
করোনা মহামারির কারণে গত কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য কমানোর প্রচেষ্টায় সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে দারিদ্র্য বেড়েছে।