দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। বাংলাদেশ থেকেও টাকা পাচার হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে বিভিন্ন পণ্যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছে।
তবে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, সে তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস।
তিনি বলেন, যে টাকা চলে যায়, তা ফেরত আনা কঠিন। বৈশ্বিক এক সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে মাসুদ বিশ্বাস আরও বলেন, গোটা পৃথিবীতে পাচার হওয়া অর্থের এক শতাংশও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকে বিএফআইইউ-এর এক সংবাদ সম্মেলনে মাসুদ বিশ্বাস এসব কথা বলেন।
এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ, বিএফআইইউ পরিচালক রফিকুল ইসলাম, মো. আরিফুজ্জামান, অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসাইন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বিএফআইইউ-এর ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
এতে উল্লেখ করা হয়, দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) ও কার্যক্রম বেড়েই চলছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ৮ হাজার ৫৭১টি। এক বছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৬২ দশমিক ৩২ শতাংশ বা ৩ হাজার ২৯১টি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২৮০টি। এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এমন লেনদেন ও কার্যক্রম হয়েছিল ৩ হাজার ৬৭৫টি। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এমন লেনদেন ও কার্যক্রম হয়েছিল ৩ হাজার ৫৭৩টি।
সংবাদ সম্মেলনে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, সব সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) অপরাধ নয়। লেনদেন সন্দেহজনক হলে তদন্ত করি। এরপর যদি কোনো অপরাধের প্রমাণ মেলে, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিই। এ পর্যন্ত অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বিএফআইইউ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরো অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৯৯৯টি সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট জমা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এর আগের অর্থবছরে ৪ হাজার ৪৯৫টি রিপোর্ট জমা দিয়েছিল ব্যাংকগুলো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রিপোর্ট জমা দেয় ১০৬টি। আর ৪৫৭টি রিপোর্ট জমা দিয়েছে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো।
প্রশ্নোত্তর পর্বে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, অর্থ পাচারের বেশির ভাগই বাণিজ্যভিত্তিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিদর্শনে বিষয়টি উঠে এসেছে। এরপর বিলাস পণ্যের এলসিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এছাড়া এলসি খোলার ওপর তদারকি বাড়ানো হয়েছে। ফলে বর্তমানে ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে না। এখন নজর দিতে হবে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের দিকে।
এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, শতভাগ স্বাধীনতা ভোগ করছে বিএফআইইউ। স্বাধীনভাবে কাজ করছি। কোনো সমস্যা নেই। জনবলের কিছু স্বল্পতা আছে, সেটা থাকবেই। কারণ বিধিতে সুস্পষ্ট বলা আছে, বিএফআইইউ যত লজিস্টিকস জনবল, অর্থবল যা কিছু আছে, সবকিছুই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাব। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকও তো প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জনবল নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে, তবে কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করছি।
তিনি আরও বলেন, এই যে হুন্ডি হচ্ছে, প্রবাসীরা ডলার পাঠাতে পারছেন না, ফরেন কারেন্সি পাঠাতে পারছেন না। তাহলে এগুলো কোথায় যাচ্ছে। সেগুলো তো কোথাও এক জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে। সেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের পেমেন্ট মেটানোর জন্য। যেহেতু রেগুলেটর এখানে তাদের মনিটরিং ও নজরদারি বাড়িয়েছে, সেহেতু ট্রেড বেইসড মানি লন্ডারিং আগামী দিনে আরও কমে আসবে।
গত এক বছরে কী পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে-এমন এক প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য বিএফআইইউ-এর কাছে নেই। তবে সব সন্দেহজনক লেনদেনে অর্থ পাচার হয় না।
তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালে প্রকাশিত জিএফআই-এর একটি প্রতিবেদনে উলেখ করা হয়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ট্রেড ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। একই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। একই সময়ে বৈশ্বিক অপর একটি সংস্থার প্রতিবেদনে উলেখ করা হয়, বাংলাদেশ থেকে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে বের হয়ে গেছে এবং ২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে এসেছে। দুই আর্থিক প্রতিবেদনে দুইরকম তথ্য এসেছে।
বিএফআইইউ অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসেন বলেন, জিএফআই একটি থিংট্যাংক প্রতিষ্ঠান। এটি গভর্নমেন্ট ও আন্তঃগভর্নমেন্ট কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। তারাও বলছে, এটা ১০০ ভাগ সঠিক না। আইএমএফ-এর ডেটাবেজে বলা হয়েছে, ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হচ্ছে।