শুরু করেছে পদ্মা ও যমুনা নদীর পানি। নদীতে স্রোত এবং ঝড়ো বাতাসের কারণে এবার আগে-ভাগেই ভাঙন শুরু হয়েছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার ঘাট এলাকায়। অথচ এই বর্ষা মৌসুমের আগেই দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটকে আধুনিক নৌবন্দরে উন্নীত করার কাজ শুরুর কথা ছিল। বর্ষার আগে গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথ এলাকার উন্নয়ন কাজ শুরু নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ফাইল চালাচালি এবং বুয়েটের ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আটকে আছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট নৌবন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্পের কাজ। পাউবোর দাবি, প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের বরাদ্দের অর্থ দিয়ে কাজ শুরু করার অনুমোদনের জন্য বিআইডব্লিউটিএ’কে চিঠি দিয়েও তার উত্তর মিলছে না। অপরদিকে বিআইডব্লিউটিএ বলছে, জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় এবং বুয়েট থেকে চূড়ান্ত নকশার অপেক্ষায় আছে তারা। ফলে আবারও ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়তে যাচ্ছে দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট, ফেরিঘাটসহ আশপাশের জনপদ। ভাঙনঝুঁকিতে আছে দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের আটটি গ্রামের প্রায় দুই হাজার পরিবার।
রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট। দৌলতদিয়া ফেরিঘাট ও এর পশ্চিমে দেবগ্রাম প্রান্তে ছয় কিলোমিটার এবং পাটুরিয়া ঘাটে দুই কিলোমিটার স্থায়ীভাবে আধুনিকায়ন করতে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক গত বছরের জানুয়ারিতে ৬৮০ কোটি টাকার প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়েছে। কাজটি বাস্তবায়নের জন্য রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে জানা যায়, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শুরু করতে না পারা এবং নির্মাণসামগ্রীর ঊর্ধ্বগতির কারণে এ কাজের বর্তমান ব্যয় বাড়িয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ৩৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আসন্ন বর্ষার আগেই পূর্বের বরাদ্দ থেকে কাজের অনুমতি চেয়ে পাউবো ২৭ এপ্রিল বিআইডব্লিউটিএ’র প্রকল্প পরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ওই চিঠির কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। বিআইডব্লিউটিএ’র দাবি, জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন না হওয়া এবং বুয়েট থেকে চূড়ান্ত নকশা না পাওয়ায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।
সরেজমিন দেখা যায়, গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া লালু মণ্ডলপাড়া পদ্মার পাড়ে শূন্য ভিটায় ছোট্ট একটি মুদি দোকান করে দুলাল মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি আশায় আছেন, যদি নদীশাসনের কাজ শুরু হয় তাহলে তাদের চিন্তা দূর হবে। তিনি জানান, গত ঈদের আগে থেকেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে তার প্রায় সাত বিঘা জমি বিলীন হয়েছে। এখন শূন্য ভিটায় ছাপড়া ঘর আর দোকান ছাড়া কিছুই নেই তার।
ওই এলাকার বাসিন্দা হাবিব মণ্ডল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দুইবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছি। প্রায় ৫০ বিঘার মতো জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এবারও ভাঙনঝুঁকিতে আছি। বাড়িঘর নিয়ে কোথায় যাবো জানি না! অনেকেই চলে গেছেন। কয়েক বছর ধরে শুধু শুনে আসছি নদীশাসন হবে।’
দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মণ্ডল বলেন, ‘প্রতি বছর শুধু মাপজোক হয়, কাজ কিছুই হয় না। চার বছর ধরে স্থায়ী কাজ হবে বলে শুনছি। বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের স্বার্থ হাসিলে পানি বৃদ্ধির সময় জিওব্যাগ ফেলে। বর্ষার আগে কাজ শুরু না হলে লঞ্চ ও ফেরিঘাটসহ আশপাশের পাঁচটি গ্রামের প্রায় ৮০০ পরিবার ভাঙনঝুঁকিতে থাকবে।’
গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা মুন্সী বলেন, ‘গত কয়েক বছরে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনে দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হয়েছে। ভূমিহীন হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। লঞ্চ ও ফেরিঘাট ভাঙনের শিকার হয়েছে কয়েকবার। আমরা অতিদ্রুত ঘাট এলাকাকে স্থায়ীভাবে রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।’
রাজবাড়ী পাউবো জানায়, গত বছর জানুয়ারিতে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকার দুই কিলোমিটার এবং লঞ্চঘাটের বিপরীতে পশ্চিমে দেবগ্রাম পর্যন্ত চার কিলোমিটারসহ মোট ছয় কিলোমিটার এলাকার জন্য ৫১০ কোটি টাকা পাস হয়েছে। এ ছাড়া পাটুরিয়া ঘাটের দুই কিলোমিটার এলাকার জন্য ১৭০ কোটি টাকাসহ ৬৮০ কোটি টাকা পাস হয়েছে। কিন্তু নকশা পরিবর্তন ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নতুন করে প্রায় এক হাজার ২শ’ কোটি টাকার প্রকল্পের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে।
রাজবাড়ী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল আমিন বলেন, ‘২৭ এপ্রিল বিআইডব্লিউটিএ’র প্রকল্প পরিচালকের কাছে কাজ শুরুর অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছি। এখন পর্যন্ত তার জবাব না আসায় কাজ শুরু করতে পারছি না। বর্ষার আগে কাজ শুরু না হলে ভাঙন দেখা দেবে। তখন জরুরিভিত্তিতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে কাজ করবো।’ তবে এটা স্থায়ী কোনও সমাধান নয় বলে তিনি মনে করেন।
বিআইডব্লিউটিএ আরিচা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘দৌলতদিয়ায় ছয় এবং পাটুরিয়ায় দুই কিলোমিটার এলাকায় আধুনিকায়নের জন্য এক হাজার ৩৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকা একনেক থেকে পাস হয়েছে। তবে দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় জমি অধিগ্রহণের কাজ এখনও সম্পন্ন হয়নি। বিষয়টি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সম্পন্ন হয়ে আসেনি। এ ছাড়া বুয়েট থেকে নকশা চূড়ান্ত অনুমোদন হয়ে আসেনি। এ কারণে কাজ শুরু করতে দেরি হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্পটি বিআইডব্লিউটিএ’র। প্রকল্পের আর্থিক ব্যয় আরও প্রায় ৭০০ কোটি টাকার মতো বাড়বে। এর মধ্যে রাস্তার কাজ করবে সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগ এবং ঘাট প্রতিরক্ষা বা নদীর পাড় বাঁধাইয়ের কাজ করবে পাউবো। বাকি সব অবকাঠামোর কাজ করবে বিআইডব্লিউটিএ।’ এই বর্ষার আগে কাজ শুরু করতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদী। আগামী সপ্তাহে পাউবোর চিঠির জবাব দেওয়া হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নদীবন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্পের পরিচালক ও বিআইডব্লিউটিএ’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ তারিকুল হাসান বলেন, ‘আমরা বুয়েট থেকে নকশার চূড়ান্ত ডিজাইনের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি।