সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে প্রাণহানি থামছেই না। উল্টো জান্তাবিরোধী আন্দোলনে ক্রমেই আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে দেশটি। রবিবার প্রধান বাণিজ্যিক শহর ইয়াঙ্গুনসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় সরকারি বাহিনী। অ্যাডভোকেসি গ্রুপ অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) জানিয়েছে, এদিন নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ৩৯ বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। এ নিয়ে দেশটিতে চলমান বিক্ষোভে নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে।
১৪ মার্চ রবিবার সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের হ্লায়াইং থারইয়া এলাকায়। সেখানে সংঘর্ষের সময় জান্তাবিরোধীরা লাঠি ও ছুরি হাতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। এতে অন্তত ২২ জন নিহত হয়। এছাড়া আহতদের মধ্যেও তিন জনের আশঙ্কাজনক।
একজন চিকিৎসাকর্মী এএফপিকে বলেন, আমি চিকিৎসার দেওয়ার সময় চোখের সামনেই তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আমি আরও দুজনকে হাসপাতালে পাঠাচ্ছিলাম। এই মুহূর্তে এটুকুই আমি বলতে পারি।
সারা দিন গুলির শব্দ শোনা গেছে এবং রাস্তায় সামরিক ট্রাকের টহল ছিল বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। এক পুলিশ সদস্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, পুলিশ ভারী অস্ত্র ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। পরে মুছে ফেলা টিকটক পোস্টে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, কোনও দয়া দেখাবো না।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, দেশটির জান্তা সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে বেইজিং। ফলে এরইমধ্যে দেশটিতে চীনা পণ্য বর্জনের ডাক উঠতে শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় রবিবার একাধিক চীনা ফ্যাক্টরিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর সামরিক সরকার চীনা কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকা এলাকাটিতে মার্শাল ল জারি করেছে।
বেইজিং বলছে, মানুষজন লোহার রড, কুড়াল ও পেট্রোল নিয়ে হামলা চালিয়েছে ১০টি কারখানায়। এ সময় বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক আহত হয়েছে। এছাড়া চীনা একটি রেস্তোরাঁতেও হামলা হয়েছে।
বার্মায় নিযুক্ত চীনা দূতাবাসের এক বিবৃতিতে সব ধরনের নৃশংসতা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং চীনা নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই বিবৃতির পরই চীনা কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকা এলাকায় সামরিক আইন জারির ঘোষণা দেয় জান্তা সরকার।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, রবিবারের সংঘর্ষে একজন পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হয়েছেন। এদিন ইয়াঙ্গুনের বাইরে অন্যান্য শহরেও আন্দোলনকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী চড়াও হলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
হতাহতের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধরপাকড়ের ঘটনা। অ্যাডভোকেসি গ্রুপ অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) জানিয়েছে, শনিবার পর্যন্ত দুই হাজার ১৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর লুকিয়ে থাকা আইনপ্রণেতারা ঘোষণা দিয়েছেন যে, সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম চলবে। তারা নিজেদেরকে মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আহ্বান জানিয়েছে। তবে সেনাবাহিনী বলছে, এই আইনপ্রণেতাদের সহায়তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।
গত বছরের নির্বাচনে ব্যাপক বিজয় পেয়েছিল সু চি-র দল এনএলডি। তবে সামরিক বাহিনীর দাবি, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় অবস্থান নিতে শুরু করে।
এনএলডির যে আইনপ্রণেতারা গ্রেফতার এড়াতে পেরেছেন, তারা পালিয়ে নতুন একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন, যার নাম কমিটি ফর রিপ্রেজেন্টিং পাইডুংসু হলত্তু (সিআরপিএইচ)। এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পেয়েছেন মাহন উইন খিয়াং থান। তিনি বলেছেন, ”এটা জাতির জন্য সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন মুহূর্ত তবে খুব তাড়াতাড়ি আলোর দেখা পাওয়া যাবে।”
মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করছে সিআরপিএইচ। একটি ফেসবুক বার্তায় মাহন উইন খিয়াং থান বলেছেন, এটা এমন একটা সময় যখন অন্ধকারে বিরুদ্ধে আমাদের নাগরিকদের লড়াই করার ক্ষমতার পরীক্ষা হচ্ছে। অতীতে আমাদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও এখন অবশ্যই আমাদের হাতে হাত ধরে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।