অনলাইন ব্যবসা বা ই-কমার্সের যত প্রসার হচ্ছে, ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার অভিযোগও তত বাড়ছে। অনলাইন ছাড়া সাধারণ পন্থায় যাঁরা সেবা নেন বা পণ্য ক্রয় করেন, তাঁদের দিক থেকেও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু অনলাইনে সেবা নিতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ প্রতিকার দিতে পারছে না অধিদপ্তর।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে (ডিএনসিআরপি) গত আট মাসে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ৪ হাজার ৯১টি অভিযোগ জমা পড়েছে। আর ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গত মাস পর্যন্ত দুই বছরে অভিযোগ জমা হয়েছে ৮ হাজার ৪১৬টি। অর্থাৎ ৫১ শতাংশ অভিযোগ জমা পড়েছে গত আট মাসে। ভোক্তার স্বার্থ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) মনে করে, ভুক্তভোগীদের খুব কমসংখ্যকই অভিযোগ নিয়ে অধিদপ্তর পর্যন্ত পৌঁছান। বাকিরা শুধু সয়ে যান।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বাইরে অভিযোগগুলো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ভালোভাবেই নিষ্পত্তি করতে পারছে। কিন্তু ভোক্তা অধিদপ্তরকে বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানা বা দণ্ড দিতে দেখা যায় না। এর কারণ হিসেবে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ওয়েবসাইটে ইংরেজি ভাষায় নানা শর্ত দিয়ে রাখে। সেখানে পণ্য দেরিতে দেওয়া, যেকোনো সময়ে ফরমাশ বা অর্ডার বাতিলসহ নানা সুযোগ তারা রেখে দেয়। ক্রেতা বা সেবাগ্রহীতা এসব শর্ত পড়ে দেখে না।
সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কী কী শর্ত দিতে পারবে, সে বিষয়ে এখনো নির্দেশিকা তৈরি করেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এই সুযোগে ইচ্ছামতো শর্ত জুড়ে দিচ্ছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তারা এ নিয়ে কাজ করছে।
গত আট মাসে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ৪ হাজার ৯১টি অভিযোগ জমা পড়েছে। আর ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গত মাস পর্যন্ত দুই বছরে অভিযোগ জমা হয়েছে ৮ হাজার ৪১৬টি।
কিছু ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিজেরাও ‘একচোখা’ নীতিতে চলেন। যেমন সরকারি সেবাদাতা সংস্থার বিরুদ্ধে নিজ থেকে অভিযান চালাতে তাদের আগ্রহ নেই। ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, বিটিসিএল, সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংস্থা এবং গণপরিবহনের মতো বিভিন্ন সেবাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও ভোক্তারা যথাযথ সেবা পান না। বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা, তাতে ক্ষতিকর কিছু থাকে কি না, তা যাচাইয়ের কাজটিও করে না ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
এমন পরিস্থিতিতে আজ সোমবার দেশে পালিত হবে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘মুজিব বর্ষে শপথ করি, প্লাস্টিক দূষণ রোধ করি’।
২০১০ সালের ৬ এপ্রিল প্রথম বাজার পর্যবেক্ষণ করে কাজ শুরু করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ পর্যন্ত তারা ৪১ হাজারের বেশি অভিযান চালিয়েছে। প্রায় ৯৭ হাজার প্রতিষ্ঠানকে ৬৮ কোটি টাকার মতো জরিমানা করেছে। এর বাইরে ১০ বছরে গ্রাহকের কাছ থেকে অধিদপ্তর ৩৯ হাজার ৮০১টি অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৯২টি বাদে বাকিগুলো নিষ্পত্তি করা হয়েছে। অভিযানের আওতায় আসা প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ওষুধের দোকান ও বাজারের খুচরা বিক্রেতা।
সরকারি সংস্থায় অভিযান বা পণ্য পরীক্ষার উদ্যোগ নেই কেন—জানতে চাইলে ডিএনসিআরপির মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, বড় কারণ জনবলের অভাব। অধিদপ্তরের পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও তা হয়নি। তিনি দাবি করেন, ভোক্তারা অভিযোগ জানালে সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
অভিযোগ ই-কমার্সে বেশি
অধিদপ্তরের হিসাবে, ওই বছর জুলাই থেকে এ পর্যন্ত যে ৮ হাজার ৪১৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে, এর মধ্যে ই-ভ্যালির বিরুদ্ধেই জমা পড়েছে ২ হাজার ৪৮০টি অভিযোগ। দারাজের বিরুদ্ধে ৯১৬টি, ফালগুনিডটকমের বিরুদ্ধে ৩১৫টি, প্রিয়শপের বিরুদ্ধে ২৯৭টি এবং পাঠাও ডটকমের বিরুদ্ধে ২৬২টি পড়েছে। বাকি অভিযোগগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পেজ খুলে ব্যবসা করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং আরও কিছু অনলাইনের বিরুদ্ধে।
ই-ভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত ৪০ লাখের বেশি পণ্য গ্রাহককে সরবরাহ করেছি। সে তুলনায় অভিযোগের অনুপাত বেশি নয়। আমরা চেষ্টা করছি এগুলোকে আরও কমিয়ে আনার।’
দারাজ কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে বলেছে, তারাও এ পর্যন্ত কয়েক লাখ ফরমাশ পূরণ করেছে। অভিযোগ এসেছে ৯১৬টি। এর বেশির ভাগই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। সফলভাবে ক্রয় আদেশ পূরণের তুলনায় অভিযোগের সংখ্যা নগণ্য।
অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্রেতারা অভিযোগ জানাতে যান না। যেমন সেলিম মাহমুদ নামের একজন ক্রেতা প্রথম আলোকে বলেন, ই-ভ্যালি থেকে তিনি ৬০০ টাকার প্রসাধন কিনেছেন। কিন্তু পণ্য হাতে পাওয়ার পর দেখেন তা মেয়াদ উত্তীর্ণ। এ নিয়ে ই-ভ্যালিকে গত শনিবারও ই-মেইল করেছেন। সাড়া পাননি। তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকারে এর আগে এক দফা অভিযোগ জানিয়েছেন। তাঁর কাছে চিঠি এসেছে শুনানির নির্ধারিত তারিখের এক দিন পর। এ কারণে আর সেখানে অভিযোগ জানাতে আগ্রহী নন তিনি।
শর্তের ফাঁকফোকর
ই-কমার্সের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশির ভাগ অভিযোগ সময়মতো পণ্য না দেওয়ার। ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। কারণ, তাঁদের শর্তে অনেক ফাঁকফোকর থাকে। বেশির ভাগ ক্রেতা এসব শর্ত না পড়ে সেবা গ্রহণ করেন।
কিছু ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিজেরাও ‘একচোখা’ নীতিতে চলেন। যেমন সরকারি সেবাদাতা সংস্থার বিরুদ্ধে নিজ থেকে অভিযান চালাতে তাদের আগ্রহ নেই। ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, বিটিসিএল, সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংস্থা এবং গণপরিবহনের মতো বিভিন্ন সেবাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও ভোক্তারা যথাযথ সেবা পান না।
আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালির ওয়েবসাইটে তাদের পণ্য কেনার যে শর্ত আছে, তা ৪ হাজার ৬০০ শব্দ এবং তা ইংরেজিতে। দারাজের ওয়েবসাইটে শর্তসমূহের শব্দসংখ্যা ৬ হাজার ৬০০। একই অবস্থা অন্যান্য ই-কমার্স সাইটে। ই-ভ্যালি ও দারাজ প্রথম আলোকে বলেছে, তারা বাংলায় শর্তাবলি উল্লেখ করা নিয়ে কাজ করছে।
ই-ভ্যালির ওয়েবসাইটে ১৬ ও ১৭ নম্বর শর্তে বলা আছে, পণ্য মজুত থাকা সাপেক্ষে সরবরাহ করা হবে। সচরাচর যে সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করা হয়, তার চেয়ে বেশি সময়ও লাগতে পারে। যেকোনো সময় অর্ডার বাতিল করা যাবে। আরও বলা আছে, অনিবার্য কারণে পণ্য সরবরাহ বিলম্বিত হতে পারে। এই অনিবার্য কারণের তালিকায় তারা রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক কর্মসূচি, সরকারি ছুটি ইত্যাদিকে রেখেছে। আবার এ-ও উল্লেখ করেছে যে ‘অনিবার্য কারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।’
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, শর্তের কারণে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হচ্ছে। তবে অভিযোগ জমা পড়লে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হওয়ার ভয়ে কোনো কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ক্রেতার সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলে। তেমনই একজন ক্রেতা মোহাম্মদ রাফি ই-ভ্যালিতে ১ লাখ ২০০ টাকার কোমল পানীয় অর্ডার দিয়েছিলেন। ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ জানানোর পর ই-ভ্যালি তাকে টাকা ফেরত দেয়। এর মাঝে অবশ্য ছয় মাস কেটে যায়।
মোহাম্মদ রাফি প্রথম আলোকে বলেন, ভোক্তা অধিকার তাঁর কাছে জানতে চেয়েছে, এই পরিমাণ পানীয় কি তিনি পান করার জন্য কিনেছেন, না বিক্রির জন্য। বিক্রির জন্য কেনা ই-ভ্যালির শর্তের ব্যত্যয়। সেখানে আইনি কোনো সুবিধা পাওয়া যাবে না বলেও কর্মকর্তারা তাঁকে জানান। ই-ভ্যালির শর্ত হলো, পুনঃ বিক্রির জন্য কোনো পণ্য কেনা যাবে না। যদিও তারা একজনকে এক লাখ টাকার কোমল পানীয় কেনার সুযোগ দিয়েছে।
ভোক্তাসংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারণ, পণ্য ও সেবার দাম ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ব্যবসায়ীদের স্বার্থই বেশি দেখছে, ভোক্তার নয়।
এম শামসুল আলম, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো শর্ত দেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখন ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা’ তৈরির কাজ করছে। খসড়া নির্দেশিকায় ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।
নির্দেশিকা তৈরি হতে আর কত দেরি—জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. জাফরউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মতামত চাওয়া হয়েছে। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে নির্দেশিকা তৈরি হয়ে যাবে।
রিটে আটকা শুনানি
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ৮৬টি অভিযোগ জমা রয়েছে। অধিদপ্তর জানিয়েছে, এসব অভিযোগের কোনো শুনানি করা যাচ্ছে না। কারণ, বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট চলছে।
ভোক্তা অধিদপ্তর জানিয়েছে, গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে তারা যখন মুঠোফোন অপারেটরদের জরিমানা শুরু করে, তার একপর্যায়ে ২০১৮ সালে রবি আজিয়াটা একটি রিট করে। ডিএনসিআরপির মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশাসনিক বিধি না থাকার যুক্তি তুলে ধরে রিটটি করা হয়েছিল। বিধিটি সম্প্রতি তৈরি হয়েছে।
গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা ও হয়রানির অভিযোগে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডকে (ডিপিডিসি) ২০১৮ সালে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এরপর রিট করে ডিপিডিসি। উচ্চ আদালত জরিমানার টাকা দেওয়ার বিষয়টি স্থগিত করেন। ভোক্তা অধিকার বলছে, বিষয়টির এখনো সুরাহা হয়নি।
‘ব্যবসায়ীদের স্বার্থই বেশি দেখা হয়’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সঠিক দাম, মাপ ও মানের পণ্য পাওয়া ভোক্তার অধিকার। সেটা ভোক্তা পাচ্ছে না। তিনি বলেন, বাসের ভাড়া নির্ধারিত হয় আসন অনুযায়ী, কিন্তু যাত্রী নেওয়া হয় গাদাগাদি করে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য সেবা দেওয়া সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব, তারা তা পালন করে না। গ্রামের মানুষ শহরের তুলনায় নিম্নমানের বিদ্যুৎ পায়। ইংরেজি মাধ্যম ও বেসরকারি স্কুলগুলোতে কী পরিমাণ টাকা নেওয়া হয়, কী মানের শিক্ষা দেওয়া হয়—তার কোনো তদারকি নেই। সরকারের বিনা মূল্যের বইয়ের ছাপা ও কাগজ হয় নিম্নমানের, বলার কেউ নেই।