মহামারি কিডনি রোগীদের পরিস্থিতি জটিল করেছে। দেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় মারা যাওয়া ২৬ শতাংশ রোগী কিডনি রোগে ভুগছিলেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে আরও যত্নবান হওয়া দরকার।
গত বছর মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়ে। কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফলাফল ছাড়া কিছু চিকিৎসা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এর ফলে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে অনেকের পরিস্থিতি খারাপ হয়। তবে মহামারির সময় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৩৫ জনের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
দেশে করোনা সংক্রমণের এক বছর পর কিডনি রোগের সেবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
এই পরিস্থিতিতে আজ ১১ মার্চ বিশ্ব কিডনি দিবস পালন করবে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘কিডনি রোগ নিয়ে ভালো থাকা যায়’। কিডনি ফাউন্ডেশনসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান দিনটি পালনের জন্য আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
কোভিড-১৯ মূলত শ্বাসতন্ত্রের রোগ। তবে গত কয়েক মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাস ফুসফুস ছাড়াও হৃদ্যন্ত্র, কিডনি, অন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। তবে কিডনি বিকল বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভোগা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে করোনার সংক্রমণ জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। তবে এ নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশে গবেষণা অব্যাহত আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সালের নিকটজন দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁকে নিয়মিতভাবে রাজধানীর একটি বড় হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করানো হতো। একপর্যায়ে তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে শরীরে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য নষ্ট হয়। রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা দেখা দেয়। রক্তচাপ অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা শুরু হয় গত বছর এপ্রিল থেকে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনায় মারা যাওয়া ২০২ জন রোগীর মৃত্যু পর্যালোচনা করেছেন একদল গবেষক। মারা যাওয়া ২০২ জনের মধ্যে ৫৩ জন বা ২৬ শতাংশ ছিলেন কিডনি রোগী।
মৃত্যু পর্যালোচনায় দেখা গেছে, করোনায় মারা যাওয়া ২০২ জনের অধিকাংশই আগে থেকে কোনো না কোনো রোগে ভুগছিলেন। ১৩৩ জনের উচ্চ রক্তচাপ ছিল, ১২৫ জনের ডায়াবেটিস ছিল, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ ছিল ৫৩ জনের এবং ২৭ জন হৃদ্রোগে ভুগছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেকেরই একাধিক সমস্যা ছিল।
ওই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রুবিনা ইয়াসমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগী উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন বা তাঁদের ডায়াবেটিস থাকে। অনেকের একই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকে।
সরকারি-বেসরকারি সূত্র বলছে, মহামারির আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম, কিডনি ফাউন্ডেশন ও সিকেডি হাসপাতালে নিয়মিত কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো। নিয়মিত না হলেও জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল, পপুলার হাসপাতাল ও ল্যাবএইড হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো। তবে মহামারি শুরু হলে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপন বন্ধ হয়ে যায়। ব্যতিক্রম ছিল রাজধানীর শ্যামলী অঞ্চলের সিকেডি হাসপাতাল। বেসরকারি এই হাসপাতালে গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ১৩৫ জনের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের পর পাঁচজন করোনায় আক্রান্ত হন। এঁদের মধ্যে একজন মারা যান।
সিকেডি হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক কামরুল ইসলাম প্রধান বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলেও আমরা প্রতিস্থাপন বন্ধ করিনি। অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিস্থাপন বন্ধ রাখার অর্থ রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া।
কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা ডায়ালাইসিস করার আগে অনেক প্রতিষ্ঠান রোগীদের করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিল। পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হলে কিডনির চিকিৎসা বিলম্ব হয়ে যেতে দেখা যায়। অধ্যাপক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তির করোনার লক্ষণ থাকলেই আমরা করোনা পরীক্ষার পরামর্শ দিই। সবার জন্য করোনা পরীক্ষা আমরা বাধ্যতামূলক করিনি।’
দেশে করোনার সংক্রমণের এক বছর পর কিডনি রোগের সেবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক হারুন অর রশিদ। এই বিশিষ্ট কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিডনি ফাউন্ডেশনে আমরা আবার সেবা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছি।