গণভোটে সামান্য ব্যবধানে ‘প্রকাশ্যে মুখ ঢাকা পোশাক’ নিষিদ্ধের বিতর্কিত প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রস্তাবে পোশাকের ধরন উল্লেখ করা না হলেও মুসলিম নারীদের বোরকা বা নিকাবকে লক্ষ্য করেই প্রচার চালানো হয়।
সুইজারল্যান্ডের নিয়ম অনুযায়ী যেকোনও বিষয়ে এক লাখ মানুষ স্বাক্ষর প্রদান করলে সেই প্রস্তাবের ওপর জাতীয় ভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে ৫১ দশমিক দুই শতাংশ মানুষ প্রস্তাবটির পক্ষে রায় দিয়েছেন। তবে দেশটির ২৬টি ক্যান্টনের (প্রশাসনিক অঞ্চল) ছয়টিতে বেশিরভাগ মানুষ এই প্রস্তাব সমর্থন করেননি। এই ছয় ক্যান্টনের মধ্যে রয়েছে দেশটির সবচেয়ে বড় তিন শহর জুরিখ, জেনেভা ও বাসেল। এছাড়া রাজধানী বার্নের অধিকাংশ মানুষও ছিলেন বিপক্ষে।
আসুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক ‘কোন কোন দেশে বোরকা-নেকাব নিষিদ্ধ’:-
ফ্রান্স
ফ্রান্স ইউরোপের প্রথম দেশ, যেখানে বোরকা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। ফ্রান্সে ৫০ লাখ মুসলমানের বাস। ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল এই আইন কার্যকর হয়। বোরকা বা নেকাব পড়লে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে।
বেলজিয়াম
২০১১ সালের জুলাইয়ে বেলজিয়ামেও নেকাব নিষিদ্ধ হয়। অর্থাৎ কোনও নারী তার পুরো মুখ কাপড়ে ঢেকে রাখতে পারবে না।
নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসে ২০১৫ সালে আইন করে বোরকা নিষিদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে জনসমক্ষে অর্থাৎ স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদির মতো জায়গায বোরকা ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইনটি কার্যকর হয় ২০১৯ সালের ১ আগস্ট।
স্পেন
পুরো স্পেনে নয়, শুধু বার্সেলোনা শহর কর্তৃপক্ষ সেখানে বোরকা নিষিদ্ধ করেছে।
ব্রিটেন
ব্রিটেনে প্রচুর মুসলিমের বাস, তাই সেখানে কোনও ইসলামি পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে স্কুলগুলোতে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হয়। ২০০৭ সালে বেশ কয়েকটি মামলার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ ঠিক করে, স্কুলে কেউ বোরকা বা নেকাব পরতে পারবে না।
সুইজারল্যান্ড
২০১৩ সালে সুইজারল্যান্ডের ইতালিয় ভাষাভাষীদের এলাকা টিসিনোতে বোরকা নিষিদ্ধের ওপর ভোট হয়। নিষিদ্ধ করার পক্ষে পড়ে ৬৫ শতাংশ ভোট। এরপর ২৬টি শহরে বোরকা নিষিদ্ধ হয়। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে লুগানো, লোকারনো, মাগাদিনোসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বোরকা নিষিদ্ধ হয়। কেউ জনসমক্ষে বোরকা পড়লে ৯ হাজার ২০০ ইউরো পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে তার।
ইতালি
ইতালির বেশ কয়েকটি শহরে নেকাব নিষিদ্ধ। উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর নোভারা কর্তৃপক্ষ সেখানে আইন করে বোরকা নিষিদ্ধ করেছে। ৭০-এর দশকেই মুখ ঢেকে রাখা সব ধরনের ইসলামিক পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইতালি।
অস্ট্রিয়া
দেশটির ক্ষমতাসীন জোট সরকার প্রকাশ্য স্থানে পুরো মুখ ঢাকা নেকাব নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে নেকাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে একমত হয়েছে সরকারের শরিক দলগুলোও। এছাড়া যারা সরকারি চাকরি করেন, তাদের মাথায় স্কার্ফ, হিজাব কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় প্রতীক পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও বিবেচনা করছে সরকার।
জার্মানি
জার্মানির বাডেন ভুর্টেমব্যার্গ রাজ্যের স্কুলে বোরকা-নেকাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, স্কুলে বোরখা বা নেকাব পরে যাওয়া যাবে না। এমন কিছু পরা যাবে না, যা মুখ ঢেকে রাখে। আগেই শিক্ষিকাদের জন্য এই নিয়ম জারি করেছিল রাজ্যটি। জরিপে দেখা গেছে, প্রায় তিন-চতুর্থাংশ জার্মানও প্রকাশ্যে বোরকাধারী নারীদের দেখতে নারাজ।
শাদ
২০১৫ সালের জুন মাসে দুটি বোমা হামলার দু’দিন পর নারীদের মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করেছে শাদ। বোরকা কোথাও বিক্রি করা হচ্ছে দেখলে তা সঙ্গে সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলা হবে বলেও ঘোষণা দেন শাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে রাখা হয়েছে কারাদণ্ডের বিধান।
ক্যামেরুন
শাদে মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ হওয়ার এক মাসের মাথায় আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনও একই সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে দেশটির পাঁচটি প্রদেশে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে।
তাজিকিস্তান
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশ তাজিকিস্তান বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধ করে। ইসলামি মুখঢাকা পোশাক পরার চেয়ে দেশটির ঐতিহ্যগত পোশাক পরায় মনোযোগী হতে নারীদের আহ্বান জানায় দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এই আইন অমান্য করলে কোনও সাজার ব্যবস্থা রাখা হয়নি, তবে শিগগিরই জরিমানা বা কারাদণ্ড চালু করা হতে পারে বলে আলোচনা চলছে দেশটিতে।
মরক্কো
আফ্রিকার ৯৯ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বীর দেশ মরক্কোতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বোরকার উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। তবে এ বিষয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি দেশটির সরকার। বোরকা পরার ব্যাপারে কোনও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে কিনা, তাও স্পষ্ট করা হয়নি। এর ফলে দেশটিতে এখনও এ নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে।
নাইজার
জঙ্গি গোষ্ঠী বোকো হারামের কার্যক্রম বেশি থাকায় দেশটির দিফা এলাকায় পর্দা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, প্রয়োজনে মাথা ঢাকা পোশাক হিজাবও আসতে পারে নিষেধাজ্ঞার আওতায়।
শ্রীলঙ্কা
২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল খ্রিস্টানদের ইস্টার সানডের প্রার্থনা চলাকালে গির্জায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন অন্তত ২৫৩ জন। এর এক সপ্তাহ পরেই মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করে দেশটির সরকার।
তিউনিসিয়া
২০১৯ সালের ৫ জুন গণজমায়েতের স্থান, গণপরিবহন ও সরকারি অফিস-আদালতে নেকাব নিষিদ্ধ করে তিউনিসিয়া সরকার।