মানুষের মৃত্যু কমাতে ‘অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প’ হাতে নিচ্ছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। হাওড় এলাকায় প্রতি কিলোমিটারে ছাউনি তৈরি এবং লাইটেনিং অ্যারেস্টার বসানোর পরিকল্পনা চলছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাউনি তৈরি কোনো সমাধান নয়। বজ্রপাত অপ্রতিরোধ্য দুর্যোগ-এই দুর্যোগে কিছু লোক মারা যাবেই। মৃত্যু কমাতে প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা।
জানা যায়, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে হাওড়াঞ্চলসহ বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় এসব ছাউনি নির্মাণে ৪৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের পরিকল্পনা চলছে। এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আকাশে মেঘের গর্জন শোনার পরপরই মাঠে থাকা কৃষক যাতে ছাউনিতে আশ্রয় নিতে পারেন, সেজন্য প্রতি কিলোমিটারে একটি করে ছাউনি তৈরি করা হবে। প্রতিটি ছাউনির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হচ্ছে সোয়া তিন লাখ টাকা।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বজ্রপাতে সৃষ্ট কারেন্টের পরিমাণ এবং কন্ডাক্টিভিটি না জানলে অ্যারেস্টারের ব্যবহার হিতে বিপরীত হতে পারে। বাংলাদেশে বজ্রপাতে ১০০ জনের মধ্যে ২১ জন ঘরের মধ্যে মারা যান। যদি ঝড়বৃষ্টির সময় ছোট ছোট ছাউনিতে অনেক বেশি মানুষ আশ্রয় নেয়, তখন সেটি আক্রান্ত হলে সেখানে থাকা সবার মৃত্যু হতে পারে।
আমেরিকার মেটেরোলজিক্যাল সোসাইটির ‘ওয়েদার, ক্লাইমেট অ্যান্ড সোসাইটি’ শীর্ষক বিশ্বখ্যাত জার্নালে বজ্রপাতের বৈশ্বিক তথ্য নিয়মিত প্রকাশ হয়। ওই জার্নালের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা (২০১৫-২০২০) প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে না; বরং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে প্রচুর রিপোর্ট হওয়ায় এসব তথ্য মানুষের কাছে বেশি প্রচার হচ্ছে। এ কারণে বজ্রপাত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসাবে আলোচিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান, বর্তমানে যিনি অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বজ্রপাতবিষয়ক গবেষণা করছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মাত্রাতিরিক্ত জনঘনত্ব, কৃষি ও পানিসহ বহিরাঙ্গনে মানুষের কাজের ব্যস্ততা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত ও সংশ্লিষ্ট বজ ঝড়ে ঘাতোপযোগিতা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুকালীন কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণে দেখা যায়, কৃষিকাজের পাশাপাশি, মাছ ধরা, পশুচারণ, বাড়ি ফেরার পথে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। এমনকি ঘরের ভেতরেও ২১ ভাগ মানুষের মৃত্যু হয়।
২০১৬ সালের মে মাসে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে সরকার। বজ্রপাতে কেউ মারা গেলে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন থেকে মৃতের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়। চলতি বছরের ৪ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ ইউনিয়নে পদ্মাপারের একটি ঘাটের ঘরে বজ্রপাতে একসঙ্গে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। বজ্রপাতে এক জায়গায় একসঙ্গে এত মানুষের মৃত্যু চরম উদ্বেগ তৈরি করে। দেশে প্রতিবছর গড়ে ২০০-এর বেশি মানুষ বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত এক বছরে (২০১৬ সালে) সর্বোচ্চ ৩৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের গেল ১০ মাসে মারা গেছেন ১৪০ জন।
ছাউনি তৈরির প্রকল্পের বিষয়ে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তাও একমত নন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতির দেশে প্রতি ইঞ্চি মাটির দাম অনেক। সেখানে একটি প্রকল্পের নামে হাওড় এলাকায় হাজার হাজার ছাউনি হলে অনেক জমি নষ্ট হবে, প্রকৃত কাজের কাজ কিছুই হবে না। তবে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহসিন প্রকল্পটি নিয়ে খুব আশবাদী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাছাইয়ের কাজ চলছে। আশা করি, দ্রুতই প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরির কাজ শেষ করতে পারব।
ফিনল্যান্ডের বজ্রপাতবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘ভাইসালা’ বাংলাদেশের বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেছে। তাদের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বজ্রপাতে ১৩ শতাংশ মৃত্যু হয় মাছ ধরার সময়, ১৪ শতাংশ মৃত্যু হয় রাস্তায় এবং সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৭০ শতাংশ মৃত্যু কৃষিকাজ করার সময়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা যুগান্তরকে বলেন, শুধু ছাউনি তৈরির অপ্রয়োজনীয় আয়োজনই নয়, আরও বেশি খরচ করা হচ্ছে বজ্রপাতের আগাম তথ্য পাওয়ার জন্য। এই খরচের কোনো মানে হয় না। যে কৃষক বা জেলে মাঠে-পানিতে কাজ করছেন, তার কাছে বজ্রপাতের আগাম তথ্য কীভাবে যাবে? তার মতে, বরং খেজুরগাছ, বাবলা ও হিজলের মতো গাছ আগের মতো মাঠে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বুঝিয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
বজ্রপাত নিয়ে জনসচেতনতায় কাজ করা নিরাপদ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ইবনুল সাঈদ যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতির কথা শুনে মনে হচ্ছে কোথায় কোথায় বজ্রপাত হবে, সেটা তারা জানেন, আর সেভাবে শেল্টার নির্মাণ করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে-অদ্ভুত ব্যাপার। তিনি বলেন, এই প্রকল্প টাকা খরচের মহোৎসব হবে। কাজের কাজ হলো খেজুরগাছ ও তালগাছ লাগানো এবং মানুষকে সচেতন করা।
পরিবেশ আন্দোলন নেতা আবু নাসের খান যুগান্তরকে বলেন, শহরে বজ্রপাত কম হওয়ার কারণ প্রায় সব বাড়ির ছাদে আর্থিঙের ব্যবস্থা আছে। এখন প্রায় সব গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। তাই গ্রামেও উঁচু টাওয়ারের মাধ্যমে আর্থিঙের সুবিধাটা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগ প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাছাইয়ের কাজ করছে। বিভাগটির চেয়ারম্যান তাওহীদা রশীদ যুগান্তরকে বলেন, বজ্রপাত থেকে বাঁচতে সেফ শেল্টারগুলোকে বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী করা যায় কি না, সেই চিন্তা চলছে।