নদ-নদীর তলদেশ স্ফীত হচ্ছে। তার সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বাড়িয়েছে। এই দুয়ে মিলে বাড়িয়ে দিয়েছে জোয়ারের পানির উচ্চতাও। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো রয়েছে সেই ষাটের দশকেরই। ফলে স্বাভাবিক সময়েই জীর্ণ, ভাঙাচোরা বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ছে। আর পূর্ণিমার সঙ্গে চন্দ্রগ্রহণ মিলে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলে পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেছে। ফলে অধিকাংশ বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে নদী আর সাগরতীরের এলাকাগুলোতে।
যদিও ২০০৯ সালে আইলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ উপকূলবর্তী এলাকার মাটির বাঁধগুলি কতটা ঠুনকো। ঘূর্ণিঝড় আইলা ও পরবর্তিতে মহাসেনের আঘাতে বিভাগের প্রায় ৭৫ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গেল বছরের মে মাসে আম্ফানে বিভাগের ১৬১ কিলোমিটার নদীর বাঁধ ভেঙেছিল। এরপরেই টেকসই (৫ মিটার উচু ও ৫ মিটার প্রস্থ) উন্নয়ন বাঁধের দাবি জোরদার হয়। সে অনুযায়ী বিভাগের ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে মাত্র ৫৯ কিলোমিটার বাঁধের টেকসই উন্নয়ন হয়েছে। তাই গত বছর আম্ফানে আবার বাঁধ ভেঙে ভাসে গ্রামের পর গ্রাম। ইয়াসেও সেই একই পরিস্থিতি।
আম্ফানের এক বছর পরেও বাঁধ-চিত্রে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসেনি। বহু জায়গায় সেই জোড়াতালি দেওয়া মাটির বাঁধই ভরসা এখনো। তাই বড় ঝড় এলে আবার ভাসতে হবে, ধরেই রেখেছেন উপকূলের মানুষজন। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলেছিল, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থসহায়তা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষ আম্পানের পরও একই কথা বলেছিল পাউবো। কিন্তু বরাদ্ধ আসেনি চাহিতা মতো। তাই ষাটের দশকের দীর্ঘ বেড়িবাঁধ বছর বছর জোড়াতালি দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছে পাউবো।
টেকসই বাঁধ
পাউবোর বরিশাল আঞ্চলিক প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয় জানান, আইলার পর ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘ইসিআরআরপি’ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু হয়। বিভাগে ৮২টি পোল্ডারের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারের আওতায় আনা হয়। পরে তহবিল জটিলতার কারণে বছর দুয়েক কাজ বন্ধ থাকে। ২০১৪ সালের জুনে সে কাজ আবার শুরু হয়। এরপর বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের প্রায় ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (সিইআইপি) আওতায় বরগুনা, পটুয়াখালী আর পিরোজপুরে ছয়টি পোল্ডারের বাঁধ উঁচুকরণে উদ্যোগ নেয়। ওই প্রকল্পের আওতায় ৫৯ কিলোমিটার বাঁধ উঁচু করে নতুনভাবে নির্মাণ ও বাঁধের তীর ব্লক দিয়ে বাঁধাই করার কাজ শুরু হয়। এই কাজের ইতোমধ্যেই প্রায় ৭০ ভাগ শেষ হয়েছে।
পাউবোর বরিশাল অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের বাঁধগুলো সেই ষাটের দশকের। পূর্নিমার জোয়ারেই তাই অধিকাংশ বাঁধ পানির কাছাকাছি আসছে। তার সঙ্গে যদি ঘূর্ণিঝড় যুক্ত হয়, তখন বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকছে। যেমনটি এবারের ইয়াসে প্রভাবে হয়েছে। তাই বাঁধগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি এখন আলোচনা নয়, এটা বাস্তবতা। পাউবো সে লক্ষ্যে প্রতিবছরই প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে দিচ্ছে। প্রকল্পে বাঁধের উচ্চতা ধরা হয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ মিটার এবং চওড়াও ৫ মিটার। এ ধরনের কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদনও হয়েছে। তবে অর্থ বরাদ্দ না আসায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।
খলনায়ক আম্ফান
আম্ফানের ধ্বংসলীলার রেশ কাটতে-না-কাটতে পূর্ণিমা আর চন্দ্র গ্রহণের সঙ্গে ইয়াস মিলে আবারও সাগর তীরের রুহিতা গ্রামের মানুষকে ভাসাল। পানির নিচে চলে গেল তাদের ঘরবাড়ি। ঘরহারা মানুষের প্রশ্ন, আম্ফান না-হয় প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আরেক দুর্যোগ ইয়াস দক্ষিণ উপকূলের কাছ দিয়েও যায়নি। কিন্তু ভেড়িবাঁধ কি ভরা কটালের জলোচ্ছ্বাসটুকুও প্রতিরোধ করতে পারবে না? কেন সময়মতো বাঁধ মেরামত হয় না, কেনই বা টেকসই উন্নয়ন বাঁধ তৈরির কাজ শেষ হলো না। ইয়াসের পর সেই সব প্রশ্ন নতুন করে উঠছে। আম্ফানের পরে যেসব জায়গায় বাঁধ মেরামত হয়েছিল, সেখানেও কোথাও কোথাও ভেঙেছে। ফলে মেরামতির কাজ কেমন হয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
মঠবাড়িয়া উপজেলার মাঝেরচরে বলেশ্বর নদীর বাঁধ ভেঙেছিল আম্ফানে। কিন্তু পূর্ণিমার কটালের জলোচ্ছ্বাসে মঙ্গলবার ফের ক্ষতি হয়েছে বাঁধের। কোথাও দশ ফুট, কোথাও বিশ ফুট মাটির বাঁধ তলিয়ে গেছে পানিতে। সেখান দিয়ে মাঝেরচরে নোনা পানি ঢুকছে। স্থানীয় মানুষের প্রশ্ন, ৬ মাস যেতে না যেতেই যদি বাঁধ ধুয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তবে সে বাঁধ মেরামতের মানে কী! তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাঁধের যে অংশ মোরামত করা হয়েছে, তা পুরাতন বাঁধের চেয়ে কম উচুঁ ছিল। পূর্ণিমার রাতে বলেশ্বর নদীর পানি সেই নিচু বাঁধ উপচে মাঝেরচরে প্রবেশ করে। এখন পুরো মঝেরচর পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। যদিও ভাটার সময় কিছু কিছু বাড়িঘর মাথা উঁকি দেয়। জোয়ারে আবার ডুব দেয়।
মঠবাড়িয়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) উজ্জ্বল কুমার কুন্ডু কালের কণ্ঠকে বলেন, মাঝেরচরের পূর্বদিকে খেঁয়া পারাপারের একমাত্র নৌঘাট সম্প্রতি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়া চরের পূর্ব ও উত্তর প্রান্তে অ্যহত নদী ভাঙনে চরের আয়তন ছোট হয়ে আসছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে সৃষ্ট অতি জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে মাঝের চরের প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ধসে গিয়েছিল। সেই বাঁধ নির্মাণ করার পর আবার মঙ্গলবার তা ভেঙে গেছে। জোয়ারের পানি ফসলি জমিতে লবণ পানি ঢুকছে। পানিবন্দি জনসাধারণ সাইক্লোন শেল্টারে অবস্থান করছেন। তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি আশ্রয় কেন্দ্রে রান্নার জন্য সিলিন্ডারসহ দুটি গ্যাসের চুলা পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও মাঝেরচরে শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে।
নদীর বালু দিয়েই বাঁধ সংস্কার
প্রতি বছর বর্ষায় বাঁধ উপচে নদীর পানিতে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীর পানির হাত থেকে ফসল বাঁচাতে প্রকল্পে বাঁধ উঁচু করার কাজ শুরু হয়েছে। নদীর বাঁধ তৈরির কাজ বালু দিয়ে করা হয়েছে। ফলে কাজের মান নিয়ে তখন থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান, নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় এক ফসলি বেশ কিছু জমির ফসল নষ্ট হয় প্রতিবছরই। সেই ফসল যাতে না নষ্ট হয়, সেই উদ্দেশ্যেই নদীগর্ভ থেকে বালুমাটি তুলে বাঁধে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের প্রশ্ন নদীগর্ভের বালি মাটির বাঁধ কি আদৌ টিকবে?
সংস্কারের নামে টাকা লুটপাটের উদ্দেশ্যেই কি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, না যেমন করেই হোক ওই প্রকল্পের টাকা ব্যয় করতে হবে সেটাই আসল উদ্দেশ্য পাউবোর? যাঁরা বাঁধের এই ঠিকাদারী কাজের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা অবশ্য বলছেন, বর্ষায় এই বাঁধ টিকে থাকা সমস্যার। আরো একটু ভালো ভাবে বাঁধ তৈরি হলে তবেই আসল উদ্দেশ্য পূরণ হতো। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘বাঁধের ভেতরের জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। তারা মাটি দিতে চান না। তাই নদী তীরের বালু দিয়ে বাঁধ সংস্কার করা হচ্ছে। বালু দিয়ে বাঁধ তৈরি করেই কাজ শেষ করা হবে না।