ঢাকা শহরের আয়তন ২৭০ বর্গকিলোমিটার। এই মেগা শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব এলাকার উঁচু-নিচু ভবনগুলো তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য অনেকাংশে দায়ী৷ একইসঙ্গে তারা এ-ও বলছেন, এসব ভবন একটু পরিকল্পিত ব্যবহার করেই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ঢাকা শহরের সব ভবনের ছাদে পরিকল্পিত বাগান করে প্রায় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা কমানো যেতে পারে।
রাজধানীর বহুতল ভবনের ছাদ বাগানের (রুফ গার্ডেন) জন্য সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিয়েছিল রাজউক। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ভবনের ছাদে গাছ লাগালে শতকরা ১০ ভাগ হোল্ডিং কর মৌকুফেরও ঘোষণা দেয়। কিন্তু ভবনের ছাদে গাছ লাগিয়ে গ্রিণ ঢাকা গড়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকরা সহযোগিতা করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম ওই সময় গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সবুজ ঢাকা কর্মসূচির মাধ্যমে রাজধানীর তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনা সম্ভব। আর রুফ গার্ডেন করলে ওই ভবনের তাপমাত্রা আরও ১ ডিগ্রি কমবে।’
তবে, পুরো ঢাকায় এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে রাজধানীর ৭ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা কমানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবেশকর্মী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘ঢাকার বাইরে অনেক বনায়ন কর্মসূচি নিলে ঢাকায় অপ্রতুল। যে পরিমাণে গাছ কাটা হয়, এর অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। ঢাকা শহরের আয়তন বিশাল। শহরের সব ছাদে পরিকল্পিতভাবে বাগান করতে পারলে প্রায় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমানো যেতে পারে।’
পরিবেশবিদরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে অব্যাহতভাবে রাজধানীর তাপমাত্রা বাড়ছে। গত এপ্রিল মাসের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিলে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনকি গত পাঁচ দশকের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল গত ২৪ এপ্রিল। আবহাওয়া অফিস বলছে, ওই দিন ঢাকায় ৪০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
এরআগে, ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় তাপমাত্রা ছিল ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই হিসাবে গত ৫৪ বছরে চলতি বছরে ঢাকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল। তবে, এদিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ধারণ করা হয় যশোরে। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত এপ্রিল মাসের পুরো সময়ই ঢাকার তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর ছিল। তবে বেশির ভাগ এলাকায় তাপমাত্রা ৩৭ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত ১০০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শাহ আলম বলেন, ‘শুধু রাজধানী নয়, সারাদেশেরই তাপমাত্রা বাড়ছে। একসময় গ্রীষ্মে যে তাপমাত্রা হতো, এখন বছরের প্রায় অন্যান্য ঋতুতেও সেই তাপমাত্রা পাওয়া যায়। আর চলতি বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় সারা দেশের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। এই তাপপ্রবাহের কারণেই মূলত তাপমাত্রা বেড়েছে। আর বৃহৎ পরিসরে বললে, জলবায়ু পরিবর্তন ও অস্বাভাবিক নগরায়ণ বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করছে।’
নগর জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন সামনের দিনগুলোতে সামাজিক সংঘাতসহ আরও বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশের শহরগুলোর বিশেষ করে ঢাকায় নগর জলবায়ুর অভিঘাতের মাত্রা ও তীব্রতা কেমন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। ফলে নগর উষ্ণতা থেকে বাঁচার উপায় কী হবে, সে সম্পর্কে কোনো গাইডলাইন তথ্য নেই। এসব বিষয়ে সরকারের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
দাতাসংস্থা বিশ্বব্যাংক কর্তৃক ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে নগরীর ত্বকের বার্ষিক তাপমাত্রা গ্রামের তুলনায় ঢাকা মহানগরে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি, রাতে ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি হতে পারে।
পারিসরিকভাবে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি এলাকার পরিমাণ ঢাকায় ২০০৩ সাল থেকে দ্রুত বাড়ছে। ঋতুভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, শীতকালে দিবা-রাত্রির তাপমাত্রার তারতম্য কমে আসছে, তাই শীতের সময়ে গরম বেশি অনুভূত হয়।
মাইক্রো-ক্লাইমেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে শহরের বাতাসে উষ্ণতা গ্রামের চেয়ে গড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। ভৌগোলিক ও স্যাটেলাইট উপাত্ত থেকে দেখা যায়, কংক্রিটের আচ্ছাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে তাপ সিঙ্কের ভূমি। যেমন কৃষি, জলাভূমি ও সবুজ ভূমির আচ্ছাদন।
একই গবেষণায় আরও দেখানো হয়েছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সবুজ ভূমির আচ্ছাদন মোট ভূমির তুলনায় মাত্র ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। এটি রাজধানীবাসীর জন্য খুবই অপ্রতুল। মোটাদাগে অস্বাভাবিক জন ঘনত্ব, কংক্রিটের আচ্ছাদনের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি, অফিস-আদালত, কলকারখানা বা পরিবহনের বর্জ্য তাপ এবং অত্যধিক বিল্ডিংয়ের আধিক্য ঢাকার বাতাস ও ভূপৃষ্ঠের ত্বকের উষ্ণতাকে ত্বরান্বিত করছে। এছাড়া ঢাকার বিল্ডিংগুলো জলবায়ু সংবেদনশীল নয়। এগুলো তাপ ধরে রাখে। আর এই উদ্বৃত্ত তাপ আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে স্থানীয় জলবায়ুকে উত্তপ্ত করছে। তাই নগরবাসী বিদ্যমান সমস্যার সঙ্গে অতিমাত্রায় উষ্ণতাও অনুভব করছে।
এসব কারণে একদিকে মানবজীবনে বাড়ছে অস্বস্তি, অন্যদিকে শক্তিসম্পদের ওপর চাপ বাড়ছে। নিত্যনতুন রোগও দেখা দিচ্ছে। যেমন ২০০০ সালের আগে ঢাকার তথা দেশের মানুষ ডেঙ্গুর সঙ্গে মোটেই পরিচিত ছিল না, কিন্তু এখন ডেঙ্গু একটা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নগরবিদরা বলছেন, এটি উষ্ণায়নের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত। একইভাবে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করছে শীতলতা বজায় রাখতে, যা অদূর ভবিষ্যতে পানিসম্পদের ওপর চাপ বাড়াবে বলেও মনে করছেন তারা।
পরিবেশবিদরা বলছেন, দিন দিন শহরে গাছপালা কমছে।জলাশয় ভরাট হচ্ছে। অথচ পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখতে এই দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। গাছপালা মানুষের নির্গত কার্বন-ডাই অক্সাইড টেনে নিয়ে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয় পরিবেশে। তেমনি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জলাশয়ের ভূমিকাও কম নয়। পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখে। ভূখণ্ডের তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলে। ভূ-তটের গভীরের পানিও থাকে স্বাভাবিক স্তরে। কিন্তু ভূখণ্ডের ওপরের জলাশয় কমে যাওয়ায় দিন দিন মাটির গভীরে পানির স্তরও ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে নিচে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ‘আগে এক সময় গ্রামাঞ্চলের রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন ফলমূলের গাছ ছিল। যেখানে বিভিন্ন পশু-পাখি এসে বসতো। সেই ফলমূল খেতে পারতো। এখন সেই গাছগুলোর জায়গায় অন্য গাছ লাগানো হচ্ছে। যেগুলো লাগানো হয়, সেগুলো পাতাবাহারের। ওখান থেকে কতটুকু কার্বন ডাইঅক্সাইড অবজার্ভ হচ্ছে, কতটুকু অক্সিজেন নিঃসরণ হচ্ছে, সেটা আমাদের দেশে মাপা হচ্ছে না।’
রাজধানীর কোন কোন এলাকায় তাপমাত্রা বেশি থাকে:
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত শতকের সত্তরের দশকে ঢাকা শহরের প্রথম তপ্ত ভূখণ্ড সৃষ্টি হয় পুরান ঢাকা ও মতিঝিল এলাকায়। এরপর পর্যায়ক্রমে শ্যামপুর, পোস্তগোলা, সায়েদাবাদ, ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার এলাকা তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর একে একে মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, বাসাবো, রামপুরা, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, শেরেবাংলা নগর, গাবতলী ও গুলশানের একাংশ। এর মধ্যে অল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায়।
১৯৯০ সালে এ দুই এলাকার বেশির ভাগই ছিল জলা ও নিম্নভূমি। আবাসন প্রকল্পের কারণে এখানে দ্রুত ইমারত ও সড়ক নির্মিত হয়েছে। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি ও সর্বনিম্ন ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।