আমরা যারা সাধারনত কিছুটা বাম ঘরনার রাজনীতির সাথে জড়িত তাদেরকে এদেশের আলেম উলামারা সাধারনত নাস্তিক মনে করে থাকেন। অথবা মুসলমানই মনে করেন না। তবে, বিষয়টা সবার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সত্য নয়। রাজনীতিতে যেসকল আলেম উলামা রাজনৈতিক মাঠে সকল শ্রেনীর রাজনেতিক নেতা-কর্মীদের সাথে সহজে মিসতেন অথবা আলোচনা করতে মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাস তাদের মধ্যে একজন।
এদেশের আলেম উলামাদের মধ্যে শায়খুল হাদিস আল্লাহা আজিজুল হক, মুফতী ফজলুল হক আমিনী, মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী ও মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসের মত আলেম উলামাদের সাথে খুব কাছা-কাছি থেকে কাজ করার, মেলামেশার ও রাজনীতি করার সুযোগ আমার হয়েছে। এটা অনেকটাই আমার সৌভাগ্য।
১৯৯৩ সালের শেষ দিকে মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাসের সাথে আমার পরিচয়। তবে, ঘনিষ্টতা হয়েছে ২০০২ সালের দিকে। মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের নেতৃত্বে টিপাইমুখ অভিমুখে লংমার্চ করতে গিয়ে তার সাথে আমার ঘনিষ্টতা। পরবর্তীতে ১৮ দলীয় জোট ও ২০ দলীয় জোট শরিক হিসাবে মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাসের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
মঙ্গলবার দিন থেকেই থেকেই শরিরটা ভালো যাচ্ছিল না। রাতে একটু আগেই বিছানায় চলে গিয়েছিলাম। আবার ফজরের নামাজ পরেই বিছানায় চলে গিয়েছিলাম। মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা’র একটা মানববন্ধন ছিল। শরিরের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। এর মধ্যে অলিদ সিদ্দিকী তালুকদারের কয়েকবারের ফোন কল পেয়ে রিছিভ করে শোক সংবাদটা শুনলাম। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাস ইন্তেকাল করেছেন। খুব, শক পেলাম।
রাজনীতিতে অনেকটাই তার বিপরিত মেরুতে অবস্থান করলেও সম্পর্কের কখনো অবনতি হয় নাই তার সাথে। ১৮ দলীয় জোট বা ২০ দলীয় জোট করতে গিয়ে দেখেছি এমন অনেকে তাকে অবহেলা করেছেন যারা হয়তো মুফতী ওয়াক্কাসের জুতা বহন করারও যোগ্যতা নাই। কিন্তু, তিনি কখনো তাদের দিকে ভ্রু-কুচকেও তাকাননি। জোটের বহু মঞ্চে তথাকথিত টোকাই রাজনীতিরাও তাকে পাশকাটিয়ে চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। ওনাকে কখনো দেখি নাই সেই নোংরা খেলায় অংশগ্রহন করতে। জোটের প্রদান বিরোধী দল বিএনপির অনেক পিয়ন-চাপরাশি পর্যায়ের নেতাকেও দেখেছি তাকে অবহেলা করতে কিন্তু, ওনাকে দেখি নাই প্রতিমোধ পরায়ন হতে। এতটাই ভদ্র ও নিরঅহংকার মানুষ ছিলেন তিনি।
২০ দলীয় জোটের শরিক হিসাবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতৃত্ব দিয়েছেন দীর্ঘ সময়। সে সময়টাতে খেলাফত মজলিশ ও ইসলামী মোর্চার দুই নেতা তাদের দলে যোগদান করলে একদিন হাসতে হাসতে বলেছিলাম হুজুর জমিয়ত ভাঙ্গার সময় হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। তিনিও মুচকি হেসে আমাকে স্নেহের সুরে বলেছিলেন, সবস্ত ফয়সালা আল্লাহ পাকের। সেদিন হাসতে হাসতে আমি কথাটা বললেও জমিয়তে ভাঙ্গন ধরতে খুব বেশী দেরি হয নাই। অল্প সময়ের মধ্যেই দীর্ঘ সময়ের সহযোদ্ধারাই তাকে জমিয়ত থেকে দূরে ঠেলে দেবার সবস্ত পক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন। তবে, জোটের প্রধান শরিক বিএনপি এক/দুই জন শীর্ষ নেতা এই ভাঙ্গনের পেছনে ইন্দন দিয়েছেন। যা মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাসকে আহত করেছিল। তারপরও তিনি ঐ নেতাদের বিরুদ্ধে কোন শব্দ উচ্চারন করেন নাই। এখানেই ছিল মুফতী ওয়াক্কাসের মহত্ব। যারা তাকে সেদিন অপমান করেছেন তারাও কেউ অপমান থেকে মুক্তি পান নাই। পাবেন বলেও আমার মনে হয় না।
ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর আমারা ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করলেও মুফতী ওয়াক্কাসের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে নাই। যেখানে বা যখনই দেখা হতো অত্যন্ত স্নেহের সাথে কথা বলতেন। জমিয়তে দুই/তিনটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রনও দিয়েছেলেন। উপস্থিত হয়েছিলাম। আমার দলের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানিকে সম্মান ও স্নেহ করতেন। গত ৪ঠা নভেম্বর ২০২০এ মুফতী ওয়াক্কাসের সাথে শেষ দেখা আমার। জমিয়তের ঐ অনুষ্ঠানে আমি ও এনডিপি মহাসচিব মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা ছিলাম।
মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাস অত্যান্ত সাদামাটা জীবন পরিচালনা করতেন। অনেকটা লৌকিকতামুক্ত জীবনযাপন করতেন তিনি। অত্যন্ত প্রখর আপনার মেধা সম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন। রাজনৈতিক আলাপে সকল মতের মানুষের সাথে কথা বলতে বা আলোচনা করতেন সময় নিয়ে। নিজের মত যে কোনভাবে চাপিয়ে দিতেন না। আলোচনার মধ্য দিয়ে নিজের চিন্তা ও মতের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতেন। নিজের নীতি আর গতিতে আপনি ছিলেন অবিচল।
এক সপ্তাহ আগে আমার দলের প্রধান জেবেল রহমান গানি যখন জানলেন মুফতী ওয়াক্কাস অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, তখন আমাকে বললেন খবর নিতে। তিনি দেখতে যাবেন। আমি আমার ব্যস্ততা ও অসুস্ততার কারনে দায়িত্বতা সঠিকভাবে পালন করতে পারি নাই। এটা অবশ্যই আমার ব্যর্থতা। আর কখনো দেখা হবে না, কথা হবে মুফতী ওয়াক্কাসের সাথে।
স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরারমত সাহসী নেতৃত্বের অবসান হলো মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাসের ইন্তেকালের মাধ্যমে। যা আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ, দেশ ও রাজনীতির জন্য খুব ভালো বিষয় নয়। তাদের মত নেতৃত্বে শূণ্যতার মধ্য দিয়ে যা হচ্ছে তা অত্যান্ত ভয়াবহ। অযোগ্যরা যখন শূণ্যস্থান পূরন করে তখন সমাজে আলোচনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। বিভাজন বৃদ্ধি পায়। যা সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতির জন্য কল্যাণকর নয়।
ভুলত্রুটর উর্ধ্বে মানুষ নয়। মুফিতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাসও হয়তো তার উর্ধ্বে নন। তবে, এমন মেধাবী, যৌক্তিক, ধীচিন্তার অধিকারী মানুষ সমাজে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেশ-জাতি ও দ্বীনের জন্য তার খেদমতগুলো কবুল করে জান্নাতে উঁচু মাকাম দান করুন।