কয়েক মাসের উন্নতি লাগামছাড়া করেছিল সবাইকে; এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে থাকলেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা ফেরার কোনো লক্ষণ নেই।
কয়েক দিন ধরেই দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর গতি ঊর্ধ্বমুখী, আর ঢাকায় সেটি সবচেয়ে বেশি। ঢাকা থেকে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কাও বেশি। কিন্তু ঢাকা থেকে বের হওয়ার দুই পথ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ও সদরঘাট ঘুরে স্বাস্থ্যবিধি মানায় অসচেতনতাই দেখা যাচ্ছে। এটা যাত্রীদের বেলায় যেমন, কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রেও তেমন। কমলাপুরে যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি কিছুটা মানতে দেখা গেলেও সদরঘাটে তার কোনো বালাই ছিল না।
ওপরে সদরঘাট, ভেতরেও
সদরঘাট হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের পথে দেড় শতাধিক লঞ্চে ৩০ হাজারের মতো যাত্রী প্রতিদিন চলাফেরা করছে বলে লঞ্চমালিক সমিতির তথ্য। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগে সংখ্যাটি আরও বেশি ছিল।
মহামারির পর লঞ্চ চলাচল শুরু হলে স্বাস্থ্যবিধি মানায় কড়াকড়ি ছিল কিছুদিন। মঙ্গলবার গিয়ে দেখা গেল, টার্মিনালে ঢোকার সময় পথে মাস্ক পরার নির্দেশনাটুকুই কেবল আছে; কেউ মানছে কি না, তা দেখার কেউ নেই। শরীরের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রও নেই। ভিআইপি গেটে একটিমাত্র জীবাণুনাশক টানেল ছাড়া বাকি সব কটি বিকল অথবা অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। আগে ঘাটে ঢোকার পথে হাত ধোয়ার অনেক বেসিন থাকলেও এখন ব্যবহার উপযোগী রয়েছে মাত্র তিনটি।বিকেলে ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা এমভি কর্ণফুলীতে গিয়ে দেখা যায়, তিনতলা লঞ্চটির নিচের দুটি ডেকে আগের মতোই গাদাগাদি করে শ চারেক লোক শুয়ে–বসে আছে। এদের মধ্যে দশ–পনেরোজন ছাড়া কারও মুখেই মাস্ক নেই। গাদাগাদি করে বসে আছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা শিশু আর বয়স্করা। রয়েছে সব বয়সের লোকজনই।
লঞ্চের ডেকে মূলত নিম্নবিত্ত লোকজনের যাতায়াত। মাস্ক পরেননি এমন পাঁচজনের সঙ্গে কথা হলে সবাই গরমের অজুহাত দেখান। হোসনে আরা তাঁর মেয়ে ও তিন বছরের নাতনিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন ভোলায়। ডেকে বসলেও কারও মুখে মাস্ক ছিল না।হোসনে আরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গরমের জন্য খুলে ফেলছি।
ভাইরাসে বয়স্কদের সংক্রমণের হার বেশি। তবে সত্তর বছরের আব্দুল জলিলকে দেখেও মনে হয়েছে বেশ নির্ভার। মাস্ক কোথায়—জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, ‘গরমে বাঁচি না। মাস্ক পকেটে।’ এরপর তিনি হেসে বললেন, ‘করোনা ভাইজ্জা খেয়ে ফেলছি। (করোনা পরিস্থিতি) অবস্থা যখন খারাপ ছিল, তখনই ধরে নাই, এখনো ধরবে না।’
লঞ্চটিতে উঠতে গিয়ে দেখা গেল একজন মাইকিং করছেন, ‘মাস্ক ছাড়া কেউ লঞ্চে উঠবেন না।’ তারপরও বেশির ভাগ যাত্রী মাস্ক ছাড়াই উঠছিল। যাদের মাস্ক মুখে ছিল, লঞ্চে উঠেই তা ঢুকে যাচ্ছিল পকেটে। লঞ্চের ভেতর নজরদারি ছিল না। প্রশ্ন করলে লঞ্চটির কেরানি মাকসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ মানে না। সচেতন করা যায় না।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বলছে, মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে যাওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি ঢিলেঢালাভাবে চলছিল। সরকারের পক্ষ থেকে নতুন নির্দেশনা না আসায় তেমনভাবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক (বন্দর) মো. গুলজার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রচারণা কার্যক্রম আছে, কিন্তু বাস্তবে মানুষ অনেক অসচেতন।
অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ টিকিট কাটার সময় মাস্ক পরে যায়। কিন্তু ভেতরে মাস্কের কথা ভুলে যায়। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগ ও তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও দায় রয়েছে বলে অভিযোগ তাঁর।
লঞ্চমালিক সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর যান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এ কারণে তাঁদের কার্যক্রমেও ঢিলেঢালা ভাব চলে আসে। তিনি বলেন, ‘(সংক্রমণ বাড়ছে) এটা গতকাল (সোমবার) থেকে সরকারের উপলব্ধি হয়েছে। সরকার নির্দেশনা দিলে আমরা পালন করব।’
কমলাপুর রেলস্টেশনে সকালে গিয়ে দেখা যায়, ট্রেন পৌঁছানোর পর যাত্রীরা প্রায় সবাই মাস্ক পরেই স্টেশন থেকে বের হচ্ছে। এমনকি স্টেশন চত্বরেও যাত্রীদের মুখেও মাস্ক ছিল। কিন্তু ট্রেনে ওঠার পরই এদের একটি বড় অংশ খুলে ফেলছে মাস্ক।
যাত্রীবোঝাই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে ছিল। ট্রেনটি স্টেশন ছাড়ার মিনিট পাঁচেক আগে বগিতে উঠে দেখা গেল, অনেকের মুখেই মাস্ক নেই। কারও মাস্ক আছে, তবে থুতনি, ব্যাগ ও হাতে। ট্রেনটির ‘ছ’ বগিতে দেখা যায়, ৬০টি সিটের প্রায় সব কটিতে যাত্রী রয়েছে। তাদের ২৮ জনের মুখে মাস্ক ছিল না।
‘চ’ বগিতেও ৬০টি সিটের সব কটিতে যাত্রী বসে ছিল। তাদের ৯ জনের মুখে একেবারেই মাস্ক নেই। তিনজনের মাস্ক ছিল থুতনিতে। বগিতে থাকা ষাটোর্ধ্ব আব্দুর রশিদ সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাগ থেকে বের করেন মাস্ক। বলেন, ‘বাসা থেকে পরে এসেছি। এখানে এসে খুলে ফেলেছি। মাস্ক পরে থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে।’
মাস্কবিহীন আরেক যাত্রী এনামুল হক বলেন, ‘বের হওয়ার সময় মাস্ক নিতে ভুলে গেছি। পরে ভাবলাম, রাস্তায় পাব। কিন্তু কমলাপুর প্রবেশের সময় গেটে পাইনি।’ তিনি বলেন, সবখানেই মাস্ক বিক্রির ব্যবস্থা থাকা উচিত। দেলোয়ার হোসেন নামের একজনের মুখে ছিল না মাস্ক। তিনি বলেন, ‘ব্যাগে ছিল, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না।’
কমলাপুর স্টেশনের প্রবেশমুখে একটি তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র চোখে পড়ে। কিন্তু যাত্রীরা তাপমাত্রা না মেপেই ঢুকছিল প্ল্যাটফর্মে, তা দেখার কেউ ছিল না। এ বিষয়ে কমলাপুরের স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, এটি কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারি করা হয়। তবে বর্তমানে এটি নজরদারি করা হচ্ছে না। তবে খুব দ্রুতই আবার নজরদারি শুরু হবে।
দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী বনলতা এক্সপ্রেসের ভেতরে জীবাণুমুক্ত করতে প্রতিটি বগিতেই ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। স্টেশন ম্যানেজার জানালেন, এই কাজটিই তারা সবচেয়ে ভালোভাবে করছেন। প্রতিবারই ওষুধ ছিটানো হয়।
স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার দাবি করেন, সোমবার ১০ জন ব্যক্তিকে মাস্ক না থাকার কারণে ২০০ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। ট্রেনের ভেতরে গিয়ে মাস্ক খুলে ফেলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বগির ভেতরে থাকা লোকদের চাপ প্রয়োগ করলে তারা পথে নামার সময় স্টেশনগুলোতে আমাদের লোকজনকে মারধর করে। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে।’
এ ছাড়া সেখানকার পুলিশকে এ বিষয়ে খুবই একটা উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ বললে আমরা কার্যকর করব।