।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া ।।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা মায়ের সন্তানরা তাদের মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠায় নিজের বুকের রক্ত দিয়ে পিচঢালা পথকে রঙ্গিন করেছিল। শাসকগোষ্টির গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল বাংলার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, মুক্তি সংগ্রাম।
তারই মাত্র ৯ বছরের মাথায় ভারতীয় উপমহাদেশের আরেকটি শহরে বাংলাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দেবার দাবিতে ১১ জন তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিল। ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরে ১৯৬১ সালের ১৯ মে মায়ের ভাষার মর্যাদার দাবীতে শহীদ হয়েছিল।
১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার শিলচর রেলস্টেশনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ১১ জন ভাষাসৈনিক। ওই দিন কাছাড় জেলার শিলচর রেল স্টেশনে জড় হয়েছিল হাজারো মানুষ। শুরু করেছিল সত্যাগ্রহ আন্দোলন। দাবি ছিল রাজ্যের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া। এই আন্দোলনকে ভালো চোখে নেয়নি আসামের তৎকালীন সরকার। আর এই আন্দোলনকে দমনের জন্য সেদিন হিংস্র হয়ে উঠেছিল আসামের আধাসামরিক বাহিনী। গুলি ছুড়ে নিরীহ মানুষের শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ওপর। সেই গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল ১১ জন তরুণ-তরুণী। সবারই বয়স ছিল ২৫ বছরের নিচে। প্রতি বছর ১৯ মে তাঁদের স্মরণে এখনো গোটা বরাক উপত্যকায় ভাষা শহীদ দিবস পালিত হয়ে আসছে।
১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে যে শিলচর স্টেশনে আর তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে আসাম পুলিশের গুলিতে এক নারীসহ ১১ জন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইতে, সেই রেল স্টেশনটির নাম ভাষা শহীদ স্টেশন। বরাকের মানুষ ২০০৫ সালে প্রথম দাবী তুলেছিলেন যে বাংলা ভাষার আন্দোলনের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিল, সেই শহীদদের মর্যাদা দেওয়ার জন্যই স্টেশনটির নামকরণ হোক ভাষা শহীদ স্টেশন।
১৯ মে ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি গৌরবময় দিন। ১৯৬১ সালের এই দিনে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরে বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দানের দাবিতে ১১ জন শহীদ হন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল এক রক্তস্নাত অধ্যায়ের মহান দৃষ্টান্ত। ঠিক তেমনি ১১ জন ভাষাশহীদের রক্তের বিনিময়ে আসামে বাংলা সরকারি ভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিল ১৯ মে’র রক্তস্নাত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে।
শুধু বাংলাদেশের বাঙালিরা নয়, আসামের বাংলাভাষী বাঙালিরাও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবনদান করেছে। ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে এ এক অমর ইতিহাস। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানের ঘটনাটি বাঙালির ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উপেক্ষিত এবং বিস্মৃত অধ্যায়। এখনো অনেক বাংলাদেশের বাঙালিরা মনে করেন, বাংলাভাষার জন্য জীবনদানের ঘটনা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও ঘটেনি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশে যেমন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিক, অহিউল্লাহসহ আরো অনেকে জীবনদান করেছেন ঠিক তেমনি আসামের শিলচরে বাংলা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন ১১ জন ভাষা শহীদ।
১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলায় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল সে আন্দোলনের কথা বাংলাদেশের জনগণের মনে চির জাগরুক হয়ে আছে। পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের নয় বছর পরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এমন আর একটি আন্দোলন হয়েছিল আসামের বরাক উপত্যকায়, সে কথা আমরা ও আমাদের প্রজন্ম অনেকেই জানি না। কিন্তু সে আন্দোলনে রক্ত ঝরেছিল। বাঙালির আত্মপরিচয় ও অধিকার রক্ষার সংগ্রামে সেখানেও শহীদ হয়েছিল এগারোটি তাজা প্রাণ।
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন এবং বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের মধ্যে একাধিক ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় অভিন্নতা। প্রথমত, দুটি আন্দোলনই সংগঠিত হয়েছিল বাংলা ভাষার উপর অন্য ভাষার ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত, দুটি আন্দোলনেই দলমত-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে দুই ভূখন্ডের বাঙালি জনগোষ্ঠী প্রতিবাদী সংগ্রামে অংশ নিয়ে আত্মদান করেছিল অধিকার আদায় করতে গিয়ে। অন্যদিকে এ দুই আন্দোলনের মধ্যে আলাদা বিশিষ্টতাও ছিল। পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষীর (৫৬%) উপর পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া সংখ্যালঘিষ্ঠ (৭%) ভাষা উর্দুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ বাঙালির ভাষা অধিকার খর্ব করে তাদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের অসমিয়াকে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। বরাক উপত্যকায় বসবাসরত বাঙালির যে ভাষা আন্দোলন তা আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের মতোই তা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল দেশবিভাগের সময় থেকে। অবশ্য সে প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্নতর।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে দ্বিধাবিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন হয়। স্বাধীন ভারতে বহু জাতি ও বহু ভাষাগোষ্ঠী অধ্যুষিত আসাম রাজ্যে বাঙালিকে বিদেশী এবং বহিরাগত রূপে চিহ্নিত করার হীন অপপ্রয়াস শুরু হয়। আসামের প্রতি বাঙালিদের আনুগত্য নিয়ে সংশয়, সন্দেহ ও প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে মহল বিশেষের উদ্যোগে প্ররোচনায়। ‘আসাম শুধু অসমিয়াদের জন্য’ এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে সেখানে বাঙালির অধিকার হরণের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চলতে থাকে। শুরু হয় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে অসমিয়াকরণের প্রয়াস। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং অন্যথায় তাদের অনুদান বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১-র মধ্যে সেখানে ২৫০টি বাংলা মাধ্যমের স্কুলের মধ্যে ২৪৭টিই বন্ধ হয়ে যায়।
আসামের বিধানসভাতেও অসমিয়াকরণের প্রচেষ্টা শুরু হয় ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বিধানসভায় অনসমিয়াদের বেলায় বাংলা, ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপনের বিধান ছিল। ঐ বছর নতুন আইন পাশ করে তা কেড়ে নেওয়া হয়। ঐ আইনে বলা হয় : ‘The business of the House shall be transacted in Assamese or in English.’ তবে ঐ বিধানে তখনও অধ্যক্ষের অনুমতিক্রমে মাতৃভাষায় বক্তব্য পেশের সুযোগ ছিল। কিন্তু ১৯৫৪ সালে বিধানসভায় একমাত্র অসমিয়াকে রাজ্যের ভাষা হিসাব গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হলে তাতে আসাম রাজ্যের সর্বত্র অনসমিয়া ভাষীদের মধ্যে বিতর্ক ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অবশ্য বেসরকারিভাবে উত্থাপিত ঐ প্রস্তাব তখন বিবেচনা না করে স্থগিত রাখা হয়।
ভাষা আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে ১৯৬০-এর এপ্রিলে। ২১ ও ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির এক সভায় অসমিয়াকে আসামের একমাত্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর পর পরই আসাম প্রদেশের শাসকবর্গ উগ্র ভাষাপ্রেমের পক্ষে অবস্থান নেন এবং অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার অপচেষ্টায় সক্রিয় তৎপরতা শুরু করেন। এর ফলে অনসমিয়া বিশেষত বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং সরকারি দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ২১ জুন ১৯৬০ শিলচরে ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’-এর উদ্যোগে এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়।
লোকসভা সদস্য শ্রী দ্বারিকানাথ তেওয়ারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ সভায় আলতাফ হোসেন মজুমদার, নন্দকিশোর সিংহ, নিবারণচন্দ্র লস্কর, রথীন্দ্রনাথ সেন, গোলাম ছগির খান, শরৎচন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বিশিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দ গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং প্রতিবাদ জানান। সভায় অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে বাঙালিদের উপর হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করা হয়।
বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনকে সংহত রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে ২ ও ৩ জুলাই ১৯৬০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’। এই সম্মেলনে আসাম রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পঁচিশ হাজার নরনারী সমবেত হয়। বিভিন্ন জাতি, উপজাতি ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্মেলন পরিণত হয় মহাসম্মেলনে। সভায় আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে একমাত্র অসমিয়ার প্রবর্তন স্থগিত রেখে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়।
এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পরই শুরু হয় দাঙ্গা হাঙ্গামা। অসমিয়াপন্থী উগ্র দাঙ্গাবাজরা পথে নামে। নির্বিচারে বহু বাঙালির বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লুঠতরাজ, হত্যা ও ধর্ষণ চলে অসমিয়া ভাষা আন্দোলনের নামে। ক্ষমতাসীন সরকার এতে পরোক্ষভাবে মদত জোগায়। যদিও সরকারের সবার এতে সমর্থন ছিল না। প্রশাসনের এক শ্রেণীর উগ্র জাতীয়তাবাদী কর্তাব্যক্তি ও পুলিশ কর্মকর্তা এসব ঘটনায় নেপথ্যে ইন্ধন জোগান।
১০ অক্টোবর আসাম বিধান পরিষদে আসাম সরকারি রাজ্যভাষা বিল উত্থাপন করা হয়। ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত এ বিল নিয়ে আলোচনা চলে। ২৪ অক্টোবর সকল সংশোধনী প্রস্তাব, অনুরোধ-নিবেদন উপেক্ষা করে রাজ্যভাষা বিল চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। এভাবে আসামের বিভিন্ন অসমিয়া উপজাতি গোষ্ঠী ও দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী লক্ষ লক্ষ বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দাবি উপেক্ষিত ও অস্বীকৃত হয়। এর প্রতিবাদে অনেক সংসদ সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। মাতৃভাষার অধিকার বঞ্চিত লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষোভে, দুঃখে, উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। ১৯৬০-এর ৬ ও ৯ নভেম্বর নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সম্মেলনের উদ্যোগে কনভেনশন আহ্বান করা হয়। কনভেনশন সংবিধান স্বীকৃত ভাষা-অধিকার সুরক্ষা করা ও মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায় সহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ক্রমেই সংহত রূপ নিতে থাকে। ১৯৬০-এর ১৮-২০ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় উপত্যকা তথা বরাক উপত্যকার বাঙালি নাথ যুগী সম্প্রদায়ের ৩৬তম বার্ষিক অধিবেশন। ঐ অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার মতো সরকারি মর্যাদা দেওয়া না হলে বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় জেলা জনসম্মেলন। সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা করার দাবি তোলা হয়। অন্যথায় সমগ্র জেলায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৪ এপ্রিল ১৯৬১ নববর্ষের দিনে কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পালিত হয় ‘সংকল্প দিবস’। সংকল্প করা হয় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। এই সংকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম হিসাবে ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয় পদযাত্রা। দুই সপ্তাহ ধরে পদযাত্রীরা ২২৫ মাইল পথ অতিক্রম করেন। গ্রামে গ্রামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রচার চালান। ২ মে তাঁরা করিমগঞ্জে এসে পৌঁছলে তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
১৯ মে ভাষা আন্দোলনের অংশ হিসাবে কাছাড় জেলার সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। আগের রাতে করিমগঞ্জে সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয়ে চলে পুলিশি হামলা। আন্দোলন ঠেকাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয় অনেক নেতা-কর্মীকে। সে খবর দাবানলের মতো রাতেই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। শহর জেগে ওঠে উত্তেজনায়। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জনতা নামে রাজপথে।
১৯ মে ভোর চারটায় শিলচর রেল স্টেশনে শুরু হয় সত্যাগ্রহীদের অবরোধ। জেলার সর্বত্র একই সময় থেকে সর্বাত্মক ধর্মঘট কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। দোকানপাট যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। কোর্ট-কাছারি, ডাকঘর, অফিস-আদালত সব কার্যালয়ের সামনে চলে পিকেটিং। গ্রেফতার বরণ করেন হাজার হাজার কর্মী।
আন্দোলনের ব্যাপকতা দেখে শাসকগোষ্ঠী মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। ভাষা আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য তারা বেছে নেয় চরম নির্যাতনের পথ। ঐ দিন দুপুর আড়াইটায় শিলচর রেল স্টেশনে তারা ধর্মঘটরত জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। শত শত লোক আহত হয়। গুলিতে শহীদ হন ১১ জন। এঁরা হলেন : শচীন্দ্র পাল, কানাই নিয়োগী, কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চন্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর ও সত্যেন্দ্র দেব।
১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলার পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠীর উগ্র ভাষানীতির মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন করে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ, তেমনিভাবে ভাষা আন্দোলনের আর এক ইতিহাস রচিত হল বরাক উপত্যকায়। তাতে খচিত হল ১১ জন শহীদের নাম।
বরাক উপত্যকার ভাষাশহীদ পরিচিতি :
১. কমলা ভট্টাচার্য : বাংলাভাষা সংগ্রামের একমাত্র মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েই ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ষোল বছর বয়সে তিনি শহীদ হন। পিতৃহীন কমলা ছিলেন অবিবাহিতা, থাকতেন ভাই রামরমণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে শিলচর শহরে। তাঁদের পরিবার ১৯৫০ সালে সিলেট ছেড়ে কাছাড়ে আশ্রয় নেন। তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে কমলা ছিলেন তৃতীয়।
২. শচীন্দ্রমোহন পাল : মাত্র উনিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বুক পেতে নিয়েছিলেন আসাম সরকারের বুলেট শচীন্দ্র পাল। তাঁদের পূর্বনিবাস ছিল হবিগঞ্জ মহকুমার নবিগঞ্জের সন্দনপুর গ্রামে। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে শচীন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। কাছাড় হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন।
৩. কানাইলাল নিয়োগী : আদিনিবাস ময়মনসিংহ জেলার খিলদা গ্রামে। মেট্রিক পাশ করে ১৯৪০ সালে রেলে চাকরি নেন। স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে শহীদ হন। তখন তাঁর মা শান্তিকণা নিয়োগীর বয়স ৭০ বছর। পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল নিয়োগী আগেই প্রয়াত।
৪. কুমুদ দাস : পিতা কৃষ্ণমোহন দাস মৌলভিবাজারের জুরি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কাছাড়ে যান। মায়ের মত্যুর পর আট বছর বয়সে কুমুদ দাস ত্রিপুরায় মামার বাড়িতে থেকে এম.ই. পর্যন্ত পড়ে গাড়িচালকের পেশা গ্রহণ করেন। পরে শিলচরের তারাপুরে চা-দোকানে বয়ের কাজ নেন। বৃদ্ধ পিতা, চার বোন ও এক শিশু ভাইকে নিয়ে সংসার ছিল তাঁদের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন কুমুদ দাস।
৫. তরণী দেবনাথ : ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সাতচল্লিশে ভারত বিভাগের সময় শিলচরে গিয়ে বসবাস [শুরু] করেন পিতা যোগেন্দ্র দেবনাথ। মৃত্যুকালে বয়ন ব্যবসায়ী তরণীর বয়স ছিল মাত্র একুশ বছর।
৬. হীতেশ বিশ্বাস : বাস্তহারা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পিতৃহীন হীতেশ বিশ্বাস মাত্র বার বছর বয়সে ত্রিপুরার খোয়াই শহরের উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দা হন। মা, ছোট ভাই ও এক বোনের সংসার ছিল তাঁদের। শিলচর শহরে ভগ্নিপতির বাসায় অবস্থানকালে মাতৃভাষার জন্য জীবনদান করেন।
৭. চন্ডীচরণ সূত্রধর : পিতৃহীন চন্ডীচরণ সূত্রধর ১৯৫০ সালে হবিগঞ্জের জাকেরপুর গ্রাম থেকে মামার সঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেন শিলচরে। পড়াশোনা এম.ই. পর্যন্ত। জীবিকা হিসেবে পৈতৃক বৃত্তি কাঠমিস্ত্রির কাজেই নিয়োজিত করেন নিজেকে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ভাষার জন্য আত্মদান করেন। তিনি তখন একা শিলচরের রাঙ্গির খাড়িতে বাস করতেন।
৮. সুনীল সরকার : ঢাকার মুন্সিবাজারের কামারপাড়া থেকে ভারত বিভাজনের বলি হয়ে শিলচর শহরের নূতন পট্টিতে গিয়ে ঘর বাঁধেন [সুনীল সরকারের] পিতা সুরেন্দ্র সরকার। ব্যবসায়ী সুরেন্দ্রের তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে সুনীল ছিলেন সবার ছোট। মাত্র এম.ই. পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন সুনীল।
৯. সুকোমল পুরকায়স্থ : করিমগঞ্জের বাগবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা পিতা সঞ্জীবচন্দ্র পুরকায়স্থ ডিব্রæগড়ে ব্যবসা করতেন। অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ১৯৫৯ সালে ‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযানের শিকার হয়ে সপরিবারে স্বগ্রামে চলে আসেন। ভাষা সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়ে মাতৃভাষার ঋণ শোধ করেন সুকোমল।
১০. বীরেন্দ্র সূত্রধর : শৈশবে বাস্তুহারা হয়ে পিতামাতার সঙ্গে নবিগঞ্জের [হবিগঞ্জের] বহরমপুর গ্রাম থেকে শিলচর যান। জীবিকার অন্বেষণে বর্তমান মিজোরামের রাজধানী আইজল শহরে গিয়ে কাঠমিস্ত্রির পেশা অবলম্বন করেন। বিয়ে করেন ত্রিপুরার ধর্মনগরে। পরে কাছাড় জেলায় অবস্থিত মণিপুর চা বাগানের কাছে ঘর ভাড়া নেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে ১৮ বছরের বিধবা স্ত্রী ও এক বছর বয়সী কন্যা রেখে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে আত্মদান করেন তিনি। শিলচর রেল স্টেশনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে ২০ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১১. সত্যেন্দ্রকুমার দেব : মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করেন। উদ্বাস্তু হয়ে ত্রিপুরায় নূতন রাজনগর কলোনিতে তিন বোন ও মাকে নিয়ে আশ্রয় নেন পিতৃহীন সত্যেন্দ্র। মা ও বোনকে সেখানে রেখে জীবিকার অন্বেষণে শিলচরে গিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পড়াশোনা ছিল প্রাইমারি পর্যন্ত। তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয় ২০ মে শিলচর রেল স্টেশনের পুকুর থেকে।
আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালিরা আজও বঞ্চিত। উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য ছোট ছোট জনগোষ্ঠী পৃথক রাজ্য পেলেও বরাক থেকে দাবিটুকুও উঠছে না সেভাবে। জনসংখ্যার নিরিখে বরাক যদি পৃথক রাজ্য হয়, তবে সেটা হবে উত্তর-পূর্ব ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য। বর্তমানে এই অঞ্চলের আট রাজ্যের মধ্যে ৩৮ লাখের ত্রিপুরা দ্বিতীয় বৃহত্তম। বরাকের লোকসংখ্যা ৪২ লাখেরও বেশি।
এ কথা গর্ব করেই বলা যায়, বাঙালি হল এমন এক জাতি, যারা মাতৃভাষা রক্ষার্থে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অথচ বরাক উপত্যকার সেই ভাষা আন্দোলনের কথা কতটুকু আমরা জানি? আমাদের এখানে ১৯৬১-এর সেই ভাষা আন্দোলনের ওপর খুব কমই আলোচনা হয়েছে।
এমন একটি মহান ঘটনা স্মরণ করা এবং ভাষাসৈনিকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। আমাদের এখানে শুধু ২১ ফেব্রুয়ারির দিনটিকে ঘিরে বাংলা ভাষার চর্চা বা আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। সারা বছর এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ বা ভাষাভিত্তিক কর্মকান্ড খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। এ রকম কর্মকান্ড সারা বছর চলতে বাধা কোথায়? ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ‘শহীদ দিবসে’ও আমরা তাদের সেই মহান আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করতে পারি। বাঙালি হিসেবে সেটাই হবে তাদের পবিত্র আত্মার প্রতি আমাদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করা।