মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় বরখাস্ত হওয়া টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি ছয়জনকে যাবজ্জীবন ও সাতজনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। গতকাল সোমবার বিকেলে রায় ঘোষণা করেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।
মামলার ১৫ আসামির মধ্যে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেন বরখাস্ত হওয়া বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক নন্দদুলাল রক্ষিত, টেকনাফ থানার কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেব এবং পুলিশের তথ্যদাতা (সোর্স) বাহারছড়ার মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন, মো. আইয়াছ ও মো. নিজাম উদ্দিন
পাশাপাশি এই ছয়জনের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
খালাস পাওয়া আসামিরা হলেন বরখাস্ত হওয়া বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং বরখাস্ত এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ।
জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে এজলাসে ওঠেন। তিনি আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর মামলা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করেন।
এরপর শুরু করেন অপরাধের পর্যবেক্ষণ বয়ান। সাক্ষ্য-প্রমাণে কার কী অপরাধ দাঁড়িয়েছে, সেসব তুলে ধরার পর হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অপরাধ অনুসারে সাজা ঘোষণা করেন। প্রধান দুই অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন।
রায় পড়ার সময় বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘আমি মেজর সিনহা হত্যা মামলাটির বিভিন্ন ইস্যু ও খুঁটিনাটি খোঁজার চেষ্টা করেছি। এতে এপিবিএনের তিন সদস্য দায়িত্বে ছিলেন। এই তিনজনই প্রথমে সিনহার গাড়িটি আটকানোর পর ছেড়ে দেন। কিন্তু পুনরায় পুলিশ কী কারণে আটকাল তাদের। তা-ও মাত্র ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে মেজর সিনহাকে লক্ষ্য করে গুলি করল। এতেই প্রমাণিত হয় সিনহা হত্যা একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ’
এর আগে দুপুর ২টার দিকে কঠোর নিরাপত্তায় আদালতে হাজির করা হয় প্রদীপ কুমার, লিয়াকতসহ ১৫ আসামিকে। এ সময় আদালতের সরকারি কৌঁসুলি, বাদীপক্ষের আইনজীবী ও আসামিপক্ষের কৌঁসুলিসহ বাদী ও বিবাদীদের স্বজন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এজলাসে ছিলেন। রায়কে কেন্দ্র করে আদালতের আশপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ১৮ মাসের মাথায় মামলার রায় ঘোষণা করা হলো। বিচারিক কার্যক্রম শুরুর পর মাত্র ৩৩ কার্যদিবসে শেষ হয়েছে মামলাটির কাজ।
কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালত সৃষ্টির ৩৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম এত দ্রুত কোনো হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হলো বলে জানিয়েছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তিনি জানান, এর আগে হত্যা কিংবা ফৌজদারি—কোনো মামলায় এত বিপুলসংখ্যক সাক্ষী নেওয়ারও নজির নেই। এমনকি নজির নেই এত স্বল্প সময়ে চার্জ গঠন, শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের।
গতকাল সকাল থেকেই পুরো আদালতপাড়ায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আদালতপাড়ার আশপাশ ও বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন নিরাপত্তাকর্মীরা। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর লোকজন কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেন। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সিনহা হত্যা মামলার রায়কে ঘিরে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেদিকে পুলিশের সর্বোচ্চ নজর রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, সিনহা হত্যা মামলায় ৮৩ সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এর আগে হত্যা কিংবা ফৌজদারি কোনো মামলায় এত বিপুলসংখ্যক সাক্ষী নেওয়ার নজির নেই। তিনি বলেন, আইনজীবীদের আশা, উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল থাকবে। স্বল্প সময়ে সিনহা হত্যার রায় দেশে মাইলফলক হয়ে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই পবিত্র ঈদুল আজহার আগের রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা। এরপর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে হত্যা মামলা করেন। মামলায় টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়।