ফিরোজা নামের বাড়িটি বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে আবেগের জায়গা। সরকারি সিদ্ধান্তে মুক্তির পর এই বাড়িটিতেই দলটির শীর্ষ নেত্রী খালেদা জিয়া প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অবস্থান করছেন। নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে না পারায় ক্ষুব্ধ বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রায়ই বলে থাকেন, নেত্রীকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হলেও তিনি কার্যত গৃহবন্দি, তাকে ফিরোজা নামে বন্দিশালায় সরকার আটকে রেখেছে।
এই বাসার বাইরে বেরোতে পারেন না খালেদা জিয়া। তার সঙ্গে উৎসব-পার্বন ছাড়া দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও দেখা করার সুযোগ পান না, তৃণমূল তো দূরের কথা। মুক্তির শর্ত হিসেবে খালেদা জিয়া দলীয় কোনো নির্দেশনাও দিতে পারছেন না।
গত বছরের ২৫ মার্চ শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির পর থেকে ফিরোজাতেই দিন কাটে খালেদা জিয়ার। তিনি বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে যাননি গত এক বছরে। তাকে বাড়ির ছাদ বা আঙিনায় কখনও দেখা যায়নি।
বাসার নিরাপত্তা কর্মীরা জানান, মাঝেমধ্যে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার, বোন সেলিমা ইসলাম, কিংবা ভাইয়ের স্ত্রী আসেন দেখা করতে। এ ছাড়া তাকে দেখতে আসেন মেডিকেল টিম। দলীয় কোনো নেতাকর্মীদের এই বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয় না। খালেদা জিয়ার আইনজীবী প্যানেলের কেউ কেউ মামলার প্রয়োজনে তার সঙ্গে দেখা করেন কালেভদ্রে। তাও অনুমতি নিয়ে, বহু আয়োজন করে এই সাক্ষাৎ করা লাগে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা গত এক বছরে অবনতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার চিকিৎসক ও স্বজনরা।
গুলশানে ‘ফিরোজা’ নামের যে বাড়িটিতে তিনি এখন থাকেন, সেটি দোতলা একটি বাড়ি। মূল ফটক ও দেয়ালের ওপর কাঁটাতারের বেড়া। এই বাড়ির ভেতরে থাকেন খালেদা জিয়া। তাকে গত এক বছরে বাড়ির ছাদেও কেউ দেখেননি।
জানা গেছে, খালেদা জিয়ার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে পত্রপত্রিকা ও বই পড়ে। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়েন। পরিমিত খাবার খান, সেটিও চিকিৎসকের পরামর্শে। এছাড়া টেলিভিশনে খবর দেখেন মাঝেমধ্যে। আত্মীয় স্বজনরা আসলে তাদের সঙ্গে গল্প করেন তিনি। তবে তিনি খুব কম কথা বলেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারা দেখা করতে পারেন না। কেবল দুই ঈদের সময় কিছু সময়ের জন্য দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয় তাদেরকে।
তিনি জানান, মুক্তির শর্তে লেখা আছে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারবেন না। সে কারণে তারা ফিরোজায় যেতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে পরামর্শ, বক্তব্য দিতে পারেন না। কারণ, শর্তে লেখা আছে, উনি রাজনীতি করতে পারবেন না। পরিবারের সদস্য ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। সেজন্য এক বছর ধরে তার রাজনৈতিক কোনো মন্তব্য বা বিবৃতি নেই।
এদিকে জানা গেছে, গত এক বছরে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। মেডিকেল টিম বারবার বলে আসছে, ৭৬ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চোখের প্রদাহ, হৃদ্রোগসহ নানা জটিলতায় ভোগছেন।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় চার–পাঁচজনের একটি মেডিকেল টিম রয়েছে। এছাড়া তার শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়মিতভাবে তত্ত্বাবধান করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। তিনি জানান, গত ১২ মাসে খালেদা জিয়ার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। কারও সাহায্য ছাড়া তিনি চলাফেরা করতে পারেন না।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, উনি ভালো নেই, তার শরীর ভালো না। তার সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন।
জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। উনাকে মুক্তি দেয়া হলেও কার্যত এখনও কারাবন্দি। উনার বিশেষায়িত চিকিৎসা দরকার কিন্তু তা হচ্ছে না। এটা তার সাংবিধানিক ও আইনগত অধিকার। সেই অধিকার থেকে সরকার তাকে বঞ্চিত করছে। চিকিৎসা সেবা পেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ১৭ বছর সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া সরকারের নির্বাহী আদেশে গত বছরের ২৫ মার্চ মুক্তি পান। মুক্তিতে দুটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়- এ সময় খালেদা জিয়া নিজ বাসায় থেকে তার চিকিৎসা গ্রহণ করবেন এবং তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। ২৪ সেপ্টেম্বর ছয় মাসের দণ্ড মওকুফের সময়ে পেরিয়ে যাওয়ার আগে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় দফায় ৬ মাসের জন্য সাজা স্থগিত করে সরকার। যা ২৪ মার্চ শেষ হবে। এর আগেই গত মঙ্গলবার পরিবারের পক্ষ থেকে দণ্ড স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোসহ কয়েকটি দাবি জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।