কাতার যেন আরেকটি বাংলাদেশ! সব হুল্লোড় আর্জেন্টিনা আর মেসিকে ঘিরে। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের অরণ্যে ফরাসি সমর্থক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সবাই যেন চাইছে লিওনেল মেসির হাতে ট্রফিটা উঠুক এবং সেদিকেই যেন যাচ্ছে ফাইনাল! এই বিশ্বাস ফ্রান্সের কয়েকজন ফুটবল বিশেষজ্ঞেরও। এই দেখে ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশমও বিহ্বল, ‘এই বিশ্বে আমি একা আছি।
এই ভালো!’ একদিকে দেশম ও তাঁর দল, অন্যদিকে পুরো ফুটবলবিশ্ব। এ রকম এক প্রেক্ষাপটে আজ লুসাইল স্টেডিয়ামে ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা।
লুসাইল স্টেডিয়াম যেন আর্জেন্টিনারও হোম ভেন্যু, এখানেই বেশির ভাগ ম্যাচ খেলেছেন লিওনেল মেসিরা। সেখানে আজও আকাশি-সাদার হাওয়া বইবে। সেই হাওয়া উন্মাতাল রূপ নেবে ‘জাদুকরের’ নতুন জাদুতে। আর্জেন্টিনার প্রতিটি ম্যাচই মেসির জাদুতে মোহনীয় হয়ে উঠছে। দল কোথাও ঠেকে গেলে তাঁর অনন্য ছোঁয়ায় পার হয়ে যাচ্ছে। টুর্নামেন্টের এমন গতি-প্রকৃতি দেখে এটা ‘মেসির বিশ্বকাপ’ বলে আগাম ভেবে নিচ্ছে সবাই। পারিপার্শ্বিক হাওয়ায় সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারেন লিওনেল স্কালোনিও। আর বোঝেন বলেই ভাবনাটা প্রশ্রয়ও দিচ্ছেন আর্জেন্টাইন কোচ। কারণ তাঁর সৌভাগ্য যে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ নিয়ে তিনি কাতার এসেছেন। এই প্রদীপের আলোয় কখন আর্জেন্টিনা রোশনাই ছড়াবে, সেটা কেউ জানে না। তবে বিষয়টি নিয়ে কোচ একান্তে কথা বলেন মেসির সঙ্গে, ‘ওর (মেসি) সঙ্গে কথা হয় মাঝেমধ্যে। কখনো সে কথা বলে, কখনো বা আমি। আমরা সবাই চাই ভালো ম্যাচ খেলে ট্রফি জিততে। এখন দেখি, সে কী সিদ্ধান্ত নেয়। ’ কোচের দেওয়া কৌশলে আর্জেন্টিনা খেলতে নামে, তবে মাঠে গিয়ে সবই বদলে যায় লিওনেল মেসির জাদুতে।
আর্জেন্টিনার মেসি আছে আর ফ্রান্সের আছে কিলিয়ান এমবাপ্পে। মেসির মতো ঠিক তাঁর একার কাঁধে চড়েনি ফ্রান্স। তবে বিশ্বকাপযাত্রায় তাদের ফাইনাল আরোহণে এই ফরাসি তারকার আছে মেসির সমান ৫ গোল। আর্জেন্টিনার সঙ্গে পার্থক্যটা হলো, বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের দলে প্রতিভার অভাব নেই। এখনই সোয়ামেনিকে ভাবা হচ্ছে লুকা মডরিচের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে। মাঝমাঠে এই তরুণের পারফরম্যান্সে অনেকখানি এগিয়ে থাকে দল। তাঁর সঙ্গে অ্যাটাকিং থার্ডে ফাইনাল বল বাড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে আন্তোয়ান গ্রিয়েজমান দারুণ খেলছেন। শক্তি দিয়ে বিচার করলে আসলে ফ্রান্স অনেক এগিয়ে। কিন্তু স্কালোনি চাইছেন একটি সুযোগ, ‘প্রতিটি দলই আলাদা। একটি দল অন্যটির সঙ্গে কখনো এক রকম হতে পারে না। ফ্রান্সের নিজেদের মতো সামর্থ্য আছে, তবে আমরাও এখানে এসেছি লড়াই করতে। এটা ফাইনাল, তাই একটি ভুলই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারে। আমরা আশা করি, ফল আমাদের পক্ষেই থাকবে। ’
সংবাদ সম্মেলনে এসে হাসিখুশি আর্জেন্টাইন কোচ দলের সবার সুস্থতার খবর জানিয়ে গেছেন। দি মারিয়াও খেলবেন ফাইনালে। তবে ফ্রান্সের ঘরে হানা দিয়েছে ‘ক্যামেল-ফ্লু’। এই জ্বরে আক্রান্ত ডিফেন্ডার দাইয়ু উপামেকানো ও মিডফিল্ডার আদ্রিয়ান রাবিও সেমিফাইনালে খেলতে পারেননি। অসুস্থতার তালিকায় নতুন যোগ হয়েছেন দুই ডিফেন্ডার—রাফায়েল ভারান ও কোনাতে এবং উইঙ্গার কোমান। পরশু তাঁরা অনুশীলনেও নামেননি। তবে পরের দুই দিনে তাঁদের উন্নতি হওয়ার কথা। ফ্রান্স কোচের মুখে অবশ্য এ নিয়ে কোনো আফসোস নেই, ‘আমরা খুব সতর্ক থেকে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছি। গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটার দিকেই আমরা জোর দিচ্ছি বেশি। ’ অর্থাৎ ক্যামেল ফ্লুর পরও ফ্রান্সের শক্তিতে খুব হেরফের হবে না। আলোচনায় আসা করিম বেনজিমার খেলার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিয়েছেন কোচ। ইনজ্যুরড করিম বেনজিমা, পল পগবা, কান্তেকে ছাড়া তারা যেভাবে ফাইনালে এসেছে, সেভাবেই তারা তৈরি হচ্ছে শিরোপা ম্যাচের জন্য।
ফ্রান্সের অগ্রযাত্রায় দলীয় শক্তির প্রকাশ থাকলেও আর্জেন্টিনার শোভা শুধু একজনে। লিওনেল মেসির আলোড়নে চাপ পড়েছে হুলিয়ান আলভারেসের ৪ গোলও! তাই ফ্রান্স গোলরক্ষক উগো লরিসও বলেছেন, ‘যত আলোচনা একজনকে ঘিরেই হচ্ছে। এটি দুই বড় পরাশক্তির মধ্যকার ফাইনাল। এটা ঠিক, এ রকম খেলোয়াড় থাকলে তার দিকে ফোকাসটা বেশি পড়বে, এটা সে-ই একমাত্র নয়। ’ দুই দলের লড়াইয়ে অবশ্য এখনো আর্জেন্টিনা ছয় জয় নিয়ে এগিয়ে। ফ্রান্স জিতেছে তিনটি। তার একটি রাশিয়া বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে আর্জেন্টিনাকে বিদায় করা ৪-৩ গোলের জয়। লিওনেল মেসি এবার সেই হারের প্রতিশোধ কি আজকের ফাইনালে নিতে পারবেন?
গণভোটের সময় নেই। তবে ফুটবলবিশ্বের প্রার্থনার চাপা ধ্বনিতে লিওনেল মেসির জন্য শুভ কামনা শোনা যায়।